নিজ এলাকা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে বিভিন্ন ছড়ার ওপর ৩৪টি কাঠের সেতু নির্মাণ করেছিলেন আলোচিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নির্মাণ করা এসব সেতুর কয়েকটি ভেঙে পড়ায় এখন পাকা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন তিনি।
সম্প্রতি হলদিউড়া গ্রামের সুতাং নদীর ওপর প্রায় আড়াই লাখ টাকায় নির্মিত ৩৫তম সেতু উদ্বোধন করেছেন এ আইনজীবী।
এ নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন জানান, এখন থেকে তিনি পাকা সেতুই নির্মাণ করবেন। তার ইচ্ছা ১০০টি পাকা সেতু বানানোর।
পাহাড়ি এলাকা চুনারুঘাটে ছড়ার ছড়াছড়ি। উপজেলার অনেক গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করেছে এসব ছড়া। গ্রামগুলোর একমাত্র সংযোগের মাধ্যম ছিল বাঁশের সাঁকো।
এসব সাঁকো পার হওয়া বেশ বিপজ্জনক। পারাপার হতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ঘটে দুর্ঘটনা। একাধিক শিশুর প্রাণহানিও হয়েছে।
নিজ এলাকার গুরুতর এ সমস্যাটি নজরে আসার পর সমাধানে উদ্যোগী হন ব্যারিস্টার সুমন। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে ছড়ার ওপর নির্মাণ করতে শুরু করেন কাঠের সেতু।
একটি, দুটি নয়; একক অর্থায়নে চুনারুঘাটে এমন ৩৪টি কাঠের সেতু নির্মাণ করেন সুমন। এর মধ্যে তিন থেকে চারটিতে কাঠের পাশাপাশি ইট-সিমেন্টও ব্যবহার করা হয়েছে।
একটি পাকাসহ সুমনের নির্মাণ করা ৩৫টি সেতু কষ্ট লাঘব করেছে উপজেলার অন্তত তিন শতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ মানুষের।
শুরুটা যেভাবে
ব্যারিস্টার সুমনের জনহিতকর এ কাজের শুরু মূলত ২০১৬ সাল থেকে। তখন তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর।
প্রথম কাঠের সেতু নির্মাণের সময় কানাঘুষা শুরু হয়, ‘এ আবার কোন নাটক!’
অনেকে বলতেন, ‘নির্বাচনে দাঁড়ানোর ধান্দা।’ তবে মানুষের এসব সমালোচনায় কান না দিয়ে কাজ চালিয়ে যান তিনি।
সুমন জানান, আইন পেশার আয় থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে সেতুগুলো নির্মাণ করেন।
তার ভাষ্য, কাঠ বা গাছ কেনা, সেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং সেতু নির্মাণ সবকিছুই করেছেন নিজের তদারকিতে। কখনো কড়া রোদ, কখনো ভারী বৃষ্টিতে নিজেই শ্রমিকদের সঙ্গে সেতু নির্মাণের কাজে হাত লাগিয়েছেন। কখনো কখনো তার এ কাজে এগিয়ে এসেছেন গ্রামের বাসিন্দা কিংবা তরুণরা।
উপজেলার রামগংগা বাগানের বাসিন্দা তপন মুন্ডা জানান, তাদের গ্রাম থেকে বের হওয়ার রাস্তায় একটি ছড়া রয়েছে। এ ছড়ার কারণে যাতায়াতে অনেক সমস্যা হতো। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বলেও একটি সেতু নির্মাণ করানো যায়নি।
তিনি আরও জানান, ব্যারিস্টার সুমন এলাকায় সেতু করে দিচ্ছেন শুনে তার কাছে কাঠের সেতু বানানোর আবদার করেন। সেতু হওয়ার পর চলাচলে আর সমস্যা হচ্ছে না।
রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চলে সুমন নির্মাণ করেছেন তার ৩২তম কাঠের সেতু। এতে ওই এলাকার অন্তত ২ হাজার মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা সুমন পানতাঁতী বলেন, বছরের পর বছর গেলেও তাদের এলাকায় কেউ সেতু বানিয়ে দেয়নি। অনেক কষ্ট করে শিশু-বৃদ্ধরা যাওয়া-আসা করত। পরে ব্যারিস্টার সুমন একটি সেতু বানিয়ে দিয়েছেন। এখন অনেক সুবিধা হয়েছে চলাচলে।
কাঠের সেতু ভেঙে পড়ায় পাকা সেতু
চার বছর আগে নির্মাণ করা কিছু কাঠের সেতু ভেঙে পড়ায় নতুন কাজ শুরু করেছেন সুমন। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে পুরোনো হয়ে যাওয়া কাঠের সেতুর জায়গায় এখন তিনি পাকা সেতু নির্মাণ করছেন।
সম্প্রতি প্রত্যন্ত এলাকা হলদিউড়া গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতাং নদীর ওপর পাকা সেতু উদ্বোধন করেছেন সুমন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগে ওই স্থানে ব্যারিস্টার সুমন একটি কাঠের সেতু নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি সেতুটি ভেঙে পড়লে পূর্ব ও পশ্চিমপাড়ের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে তিনি সেখানে পাকা সেতুটি নির্মাণ করে দেন।
গ্রামের আফিয়া খাতুন জানান, আগেও ব্যারিস্টার সুমন একটা সেতু বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ভেঙে যায়। পরে তিনি একটি পাকা সেতু বানিয়ে দিয়েছেন। এতে দুই পাড়ের মানুষের বেশ সুবিধা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বারিস্টার সুমন সাব খালি ব্রিজ না, আরও অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করইন আমরারে। আমরা দোয়া করি আল্লা যেন তারে সবসময় বালা রাখইন।’
হলদিউড়া গ্রামের ৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী তোফায়েল মিয়া বলে, ‘আগে আমরা মাদ্রাসায় যাইতে পারতাম না। ইখন আমরার মাদ্রাসায় যাইতে কুনু সমস্যা হয় না।’
কেন পাকা সেতু
কাঠের সেতুর পরিবর্তে পাকা সেতু নির্মাণ নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন জানান, কাঠের সেতু তিন বছরের বেশি যায় না। এ জন্য এখন থেকে পাকা সেতু নির্মাণ করবেন।
এ আইনজীবী বলেন, ‘সরকারের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে নিজেরটা নিজেই করতে হবে। একটা পাকা সেতু করতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাগে।
‘আমার এখন ইচ্ছা এক কোটি টাকা দিয়ে ৫০টি সেতু করার। সব মিলিয়ে এমন ১০০টি সেতু নির্মাণ করতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষের সেবা করার এমন সুযোগ তো সবার হয় না। আমার যেহেতু সুযোগ আছে, চেষ্টা করছি।’