দেশ ৩-জি, ৪-জি ছাড়িয়ে যখন ৫-জি ইন্টারনেটের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ভাবাচ্ছে ইন্টারনেটের কচ্ছপ গতি।
ইন্টারনেট ব্যবহার ও গতি নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম, অর্থ্যাৎ পেছন থেকে তৃতীয়। এমন অবস্থায় কারণ খুঁজতে শুরু করেছে এ খাতের অভিভাবক সংস্থা বিটিআরসি।
ইন্টারনেটের গতি কম নিয়ে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এতে মোবাইল অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই তথ্য বিটিআরসিতে জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে মিটিং করেছি। কিছু রিপোর্ট চেয়েছি। রিপোর্ট পাওয়ার পর বিস্তারিত বলা যাবে; কেন গতি আশানুরূপ না। এ বিষয়ে আমরা পরে জানাব।
‘আমাদের ফোকাস হচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। মূলত মোবাইল নেটওয়ার্ক (ইন্টারনেট) গ্রহীতার সংখ্যাই বেশি। ব্রডব্যান্ডেও সমস্যা আছে। টোটাল নেটওয়ার্ক নিয়েই তো প্রশ্ন। তবে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা বেশি। আমরা বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী ছক করে রিপোর্ট চেয়েছি, কেন স্পিড পাচ্ছে না। কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে, কোন কোন জায়গায় অসুখ (সমস্যা) আছে, তারা খোলামেলা মন নিয়ে আমাদের জানাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কিছুদিনের মধ্যে ৫-জি নেটওয়ার্ক চালু করতে যাচ্ছে। এখন ৪-জি নেটওয়ার্ক হয়ে গেছে, কিন্তু গতি সেভাবে নেই। এ মাসের মধ্যেই স্টেক হোল্ডাররা তথ্য জানাবে।
‘আগামী ১১ তারিখ একটা প্রেজেন্টেশন দেয়ার কথা রয়েছে। এ মাসের মধ্যেই একটা রিপোর্ট পাব। রিপোর্ট পেলে আমরা সরকারকে জানাব কোন কোন জায়গায় সমস্যা।’
বিটিআরসি সূত্র জানায়, বৈঠকে ইন্টারনেটের গতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিই কম গতির কারণ যাচাই করে দেখবে। কমিটি শিগগির এ নিয়ে কাজ শুরু করবে।
বিটিআরসির তথ্য চাওয়ার বিষয়ে মোবাইল অপারেটর রবির মিডিয়া শাখা জানিয়েছে, তাদের কাছে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি আসেনি। গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ইন্টারনেটে কেমন গতি বাংলাদেশে
ইন্টারনেট অ্যাকসেস ও পারফরম্যান্স অ্যানালিসিস কোম্পানির (ওকলা) সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের গতির হিসাবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৭ দেশের মধ্যে ১৩৫তম।
মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে সুদান, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও উগান্ডার মতো দেশও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের চেয়ে। পেছনে আছে শুধু আফগানিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।
ওকলার তথ্য বলছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গতির ইন্টারনেট রয়েছে সংযুক্ত আরব-আমিরাতে। ডাউনলোডের গতি ১৯৩ এমবিপিএসের বেশি। শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার, নরওয়ে ও সাইপ্রাস।
অনলাইনে ইন্টারনেটের গতি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্পিডটেস্ট ডট নেটে ১৩৭টি দেশের মোবাইল ইন্টারনেট গতির হিসাব রয়েছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়া, সিরিয়া, উগান্ডা ও সোমালিয়ার মোবাইল ইন্টারনেটে ডাউনলোড স্পিড ছিল ১৬ দশমিক ৬ থেকে ২২ দশমিক ২ এমবিপিএস পর্যন্ত।
সেখানে বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটে ডাউনলোড স্পিড ১২ দশমিক ৪৮ মেগাবিট পার সেকেন্ড (এমবিপিএস)। আর আপলোড স্পিড ৭ দশমিক ৯৮ এমবিপিএস। বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা ও আফগানিস্তান।
বিটিআরসির হিসাবে, মে মাস শেষে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৭৫ লাখে। সবশেষ ৯০ দিনে একবার কেউ ইন্টারনেটে সক্রিয় হলেই তাকে গ্রাহক হিসেবে গণ্য করা হয়। বিটিআরসির হিসাবে, ব্রডব্যান্ডের গ্রাহক সংখ্যা ৯৮ লাখের কিছু বেশি।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশের মধ্যে ভিয়েতনাম ৫৮, মালয়েশিয়া ৮৯, কম্বোডিয়া ৯১, নেপাল ১০৫, মিয়ানমার ১০৯, পাকিস্তান ১১৪, ভারত ১২২ এবং শ্রীলঙ্কা ১২৯তম অবস্থানে রয়েছে।
মোবাইল ইন্টারনেটের তুলনায় অবশ্য ব্রডব্যান্ডে বাংলাদেশ কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে মে মাসের তুলনায় জুনে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি সামান্য বাড়লেও বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
স্পিডটেস্টের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ১৮১টি দেশের মধ্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৮তম, যা মে মাসে ছিল ৯৬তম।
মোবাইল সেবা মনিটরিং করবে বিটিআরসি
মোবাইল অপারেটরদের নানা সেবা নিয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মান পর্যবেক্ষণ ও অপারেটরদের কার্যক্রম তদারকির জন্য মনিটরিং সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। এজন্য কানাডাভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
৭৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব সরঞ্জাম কিনছে বাংলাদেশ। এরপর প্রতিষ্ঠানটি ১৮০ দিনের মধ্যে টেলিকম মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করবে।
সম্প্রতি এ চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘মোবাইল অপারেটরদের সেবার গুণগত মান নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। গুণগত মান রক্ষার যেসব বিষয় আছে, আমরা সেগুলো মনিটরিং করে আসছি। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া কাজটি পুরোপুরি করা অসম্ভব। সেজন্য আমরা প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছি।’
বিটিআরসি জানিয়েছে, নতুন প্রযুক্তিতে প্রতিটি মোবাইল অপারেটরে বিটিআরসির ডাটাবেজ যুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে তাদের ভয়েস কল, এসএমএস থেকে সব সেবাই মনিটরিং করা যাবে। এসব সেবার মানও দেখা যাবে।
ইন্টারনেট স্পিড থেকে শুরু করে নেটওয়ার্ক-সব কিছুই বিটিআরসির নজরে থাকবে। শহর এলাকার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল, দ্বীপ, হাওড়-বাঁওড়, উপকূলীয় অঞ্চল ও দুর্গম এলাকার টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের প্রকৃত অবস্থাও তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হবে।