পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্র, ব্যাগসহ নানা পণ্য তৈরি করা হয়েছে আগেই। তবে পাট দিয়ে ফর্মুলা ওয়ানের আদলে রেসিং কার তৈরি অনেকটাই অচিন্তনীয়।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের একঝাঁক মেধাবী শিক্ষার্থী অভাবনীয় সেই কাজটিই করে দেখিয়েছেন। পাট দিয়ে ‘কিলোফ্লাইট আলফা’ নামে একটি রেসিং কার তৈরি করেছেন তারা।
পাটের আঁশের বডির কারটি নিয়ে তারা অংশ নেন ইউরোপে ইঞ্জিনিয়ারদের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা ‘ফরমুলা স্টুডেন্ট’-এ। সেই প্রতিযোগিতায় ৬৪টি দেশের মধ্যে ৩৩তম হয়েছে দলটি।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কিলোফ্লাইটের ড্রাইভ ট্রেইন এক্সপার্ট অম্লান বিশ্বাস জানান, গাড়িটি মূলত ফর্মুলা স্টুডেন্টকে টার্গেট করে বানানো। এ গাড়িটির বিশেষত্ব, সম্পূর্ণ বডি পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি। এটি দেশের ঐতিহ্যকে ধরে করা হয়েছে।
এ ছাড়া উন্নতমানের ইঞ্জিন, গিয়ার, ব্রেক, মিটার দেয়া হয়েছে। চালকের জন্য রয়েছে সুরক্ষাব্যবস্থা। গাড়িটি ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।
তিনি বলেন, ‘গাড়িটি তৈরির পর ফর্মুলা স্টুডেন্ট ইউকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। প্রতিযোগিতাটি স্টুডেন্টদের জন্য একটি ইঞ্জিনিয়ারিং রেসিং কম্পিটিশন। করোনার কারণে তারা প্রতিযোগিতাকে দুই ভাগে করেছে। একটা লাইভ ইভেন্ট এবং অন্যটি অনলাইন ইভেন্ট।
‘করোনার রেড জোনের কারণে ইউরোপের দেশগুলো লাইভ ইভেন্টে এবং বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশগুলো অনলাইন ইভেন্টে অংশ নিয়েছে। বিশ্বের ৬৪টি দেশের মধ্যে আমরা ৩৩তম হয়েছি। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে একমাত্র আমরাই অংশ নিয়েছি। এটা আমাদের জন্য একটা বড় অর্জন।’
তিন বছরের চেষ্টায় গাড়িটি তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে অম্লান বলেন, ‘আগামী বছর চ্যাম্পিয়নশিপের টার্গেট করেই কাজ করছি। আশা করছি দেশবাসীকে গর্বিত করতে পারব।
‘বাংলাদেশে গাড়ির উন্নয়ন নিয়েও কাজ করব। এই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের গাড়ি তৈরি করা। প্রতিবছর নতুন নতুন গাড়ি উদ্ভাবনের পরিকল্পনাও রয়েছে।’
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কিলোফ্লাইটের টিম ম্যানেজার সাফায়েত সাইমুম বলেন, ‘টিম কিলোফ্লাইট তৈরিতে ২০১৮ সালে উদ্যোগ নেয়া হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসে গাড়িটি তৈরি শেষ হয়। এটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া। প্রতিযোগিতার বিচারকরা বলতে পারবেন আমরা গাড়িটা কত ভালো মানের বানিয়েছি।’
কিলোফ্লাইট দলের ক্যাপ্টেন এরফান ইসলাম বলেন, ‘অটোমোবাইলে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য এই উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও নিজেদের অর্থায়নে এই রেসিং কারটি তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘গাড়িটির বডি পাটের আঁশের কম্পোজিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের পাটশিল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে।
‘এখন বিশ্বের সব ক্ষেত্রে গাড়ির বডি তৈরিতে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করা হয়। সেখানে যদি দেশীয় তৈরি জুট ফাইবার রিপ্লেস করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের সুযোগ হবে।’
ভবিষ্যতে তাদের চালকহীন গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রথম কাজটি শুরু হয়। প্রজেক্টের শুরু থেকেই তাদের অ্যাকাডেমিক অ্যাডভাইজার হিসেবে ছিলাম।
‘শিক্ষার্থীদের ২৮ জনের টিমকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর তারা নিজেরাই ডিজাইন করে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এবং আমাদের শিক্ষকদের সহযোগিতায় সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে।’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা নিজস্ব টেকনোলজিতে গাড়ি তৈরি করেছে, কুয়েটে এটিই প্রথম। এটা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিপার্টমেন্টের গর্ব। একই সঙ্গে দেশের জন্য এটি মাইলফলক। যদি আমরা অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির ডেভেলপমেন্ট চাই, তাহলে এই কাজের জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতে পারি।
‘এই প্রজেক্টে সাবেক শিক্ষার্থী এবং নিজস্ব অর্থায়ন ও মেধা খাটিয়ে গাড়িটি তৈরি করেছে। ফান্ড কালেকশনে যে পরিমাণ মেধা ও সময় ব্যয় হয়েছে, সেটা যদি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সরকারি অর্থায়নে হতো, তাহলে তাদের সময় ও মেধা গাড়ি তৈরির কাজে লাগাতে পারত। এতে কাজটি দ্রুত এবং ভালো হতো।’
ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক ড. সাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব বলা হচ্ছে কারণ জুট কম্পোজিট করে এটা তৈরি করা হয়েছে। করোনার কারণে আমরা কুয়েটের ল্যাব ব্যবহার করতে দিতে পারিনি। ৫ থেকে ৭ জনের গ্রুপ করে তারা প্রজেক্ট শেষ করেছে।
‘উন্নত বিশ্বে এই ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে অনেক রিসার্চ চলছে। তবে এই প্রজেক্ট নিজস্ব এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে করা হয়েছে। সরকারি অর্থায়ন পেলে তারা আরও ভালো করতে পারত। সরকার সব বিষয়ে সহযোগিতা করছে, এ বিষয়েও ফান্ড দেবে বলে আশা করছি।’