যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধনের পর প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়ার। দক্ষিণাঞ্চলকে প্রযুক্তির হাব হিসেবে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনাও নেয়া হয়।
তবে চার বছর পূর্তির আগেই সফটওয়্যার পার্কটিকে ঘিরে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এরই মধ্যে পার্ক ছেড়ে গেছে ২০টি প্রতিষ্ঠান।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, ইজারামূল্য নিয়ে বিরোধ, উচ্চগতির ইন্টারনেট না থাকা, বিদ্যুৎ সেবা নিয়ে ভোগান্তির কারণে বাড়েনি ব্যবসার পরিধি।
আইটি পার্কটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগ সামনে এসেছে।
এমন সংকট নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন সফটওয়্যার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেমিকোলন আইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা পারভেজ মাহমুদ হীরা।
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা এগিয়ে যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের, সে ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যে লক্ষ্যে, সে লক্ষ্য পূরণে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ছিল সেদিকে আগাচ্ছে না পার্কটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার প্রথমে নিজে দায়িত্ব নেয়ার কথা থাকলেও পরে তা দেয়া হয়েছে একটি তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠান টেক সিটির হাতে।
‘তারা সরকার নির্ধারিত প্রতি বর্গফুটে ১৪ টাকা ভাড়া নেয়ার কথা থাকলেও নিচ্ছে ১৮ থেকে ২২ টাকা।’
তার অভিযোগ, সেখানে বিদ্যুতে সরকারের ভর্তুকি দেয়ার কথা থাকলেও তা না দিয়ে নেয়া হচ্ছে ১৪ টাকা ইউনিট হিসাবে।
হীরা বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে সরকার যদি সফটওয়্যার ও বিভিন্ন আইটি সেবা নিত, তাহলে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ভিত্তি পেত। যা করা হয়নি।’
আইটি পার্কটিতে বিনিয়োগ আনতে একটি অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়েছে।
ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠন।
পার্কটির ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ভাড়া তুলনামূলক বেশি। একেক প্রতিষ্ঠানের থেকে একেক রকম ভাড়া আদায় করা হয়। বারবার মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে সর্বোচ্চ রেটে আমরা বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছি। এই বিদ্যুৎ বিল কমানোর বা বিলটা বিশেষ শিল্প জোনের আওতায় আনার জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানো হয়েছে, যদিও সমস্যার সমাধান হয়নি।’টেকসিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্নীতিরহাইটেক পার্কটি ইজারা নিয়েছে টেকসিটি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলাম।তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ বিল সরকার থেকে ৩৭ লাখ টাকা প্রণোদনা দেয়া হলেও টেকসিটি আমাদের কাছে আবার বিদ্যুৎ বিল নিয়েছে। সেই টাকার কোনো হিসাব টেকসিটি আমাদের দেয়নি। আমরা এটা নিয়ে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দিলেও কোনো সুরাহা হয়নি।’যা বলছে টেকসিটি
শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা টেকসিটির ব্যবস্থাপক মেজর (অব.) এম ইউ সিকদার জানান, সারা দেশের ৩৯টি হাইটেক পার্কের মধ্যে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি রোল মডেল ও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। তাদের ১৫ বছরের জন্য ট্যাক্স ফ্রি করে দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিশ্বমানের যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলোও ভর্তুকি মূল্যে দিচ্ছে। পাশাপাশি করোনার কারণে আইটি বিজনেসেও ধাক্কা লাগায় উদ্যোক্তাদের আট মাসের ভাড়া সরকার মওকুফ করেছে বলেও তার দাবি।
তিনি জানান, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটিতে ১৫ তলা ভবনে আড়াই লাখ বর্গফুট জায়গা ইজারাযোগ্য। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ৯৫ হাজার বর্গফুট জায়গা ইজারা দেয়া হয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে ফেলে রেখেছে।
বর্তমানে পার্কটিতে ৫৫টি আইটি ও আইটিএস বিজনেস প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে ৪৫টি কোম্পানি কাজ করছে।
এ ছাড়া ৯৮ হাজার বর্গফুটের ১২তলা আবাসিক ভবন (ডরমিটরি), ২৫ হাজার বর্গফুটের বেজমেন্ট ফ্লোরসহ তিনতলা মাল্টিপারপাস ভবন রয়েছে পার্কটিতে।
টেক সিটি জানায়, সেখানে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে কার্যক্রমে রয়েছে ৩৮টি। অবশ্য সরেজমিনে গিয়ে ৩২টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পাওয়া যায়।টেক সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুর রহমান পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের অনেকে ভাড়া দিচ্ছেন না। তাদের কাছে ৬০-৭০ লাখ টাকা ভাড়া এখনও পাওনা।’
মূল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কম
হাইটেক পার্কে চালু ৩২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশই কল সেন্টার পরিচালনা, ডিজিটাল বিপণন, গ্রাফিকস ডিজাইনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। পার্কে সফটওয়্যার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ছয়টি। সেগুলো হলো মাইক্রো ড্রিম আইটি, টেকনোসফট বাংলাদেশ, সফট এক্স টেকনোলজি, ডেসটিনি আইএনসি ডট, সেমিকোলন আইটি ও অংশ ইন্টারন্যাশনাল।
সেমিকোলন আইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা পারভেজ মাহমুদ হীরা বলেন, ‘এখানে সফটওয়্যার উৎপাদন করে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ কলসেন্টার। কলসেন্টারগুলো কি দেশের প্রযুক্তি খাতকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারবে?
‘প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের কোনো প্রণোদনা নেই। এ জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বাড়ছে না।’
যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি উদ্বোধন করা হয়। ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত হয় পার্কটি।