রাজধানীর হলি ক্রস কলেজের শিক্ষার্থী সোফিয়া মুন্সী। একাদশ শ্রেণির সোফিয়া করোনার কারণে প্রায় ঘরবন্দি। তবে তার পড়ালেখা থেমে নেই; আছে কলেজ এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগও। প্রতিদিনই নিয়ম করে অনলাইন ক্লাস করে। তাকে শুধু মানতে হচ্ছে করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি।
সোফিয়া মুন্সীর মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীই বর্তমানে এমন সময় পার করছে। এক কথায় বলতে গেলে, মহামারির এই সময়ে তাদের শিক্ষাজীবন আসলেই থেমে নেই; যা সম্ভব হয়েছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর কল্যাণে।
যেখানে ২০০৮ সালে যে বাংলাদেশ ছিল, তাতে করোনা মহামারির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত সোফিয়াদের মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর প্রযুক্তির যে বিকাশ হয়েছে, তার সুবিধা নিয়ে নতুন নতুন পরিস্থিতি সহজেই মোকাবিলা করতে পারছে নতুন প্রজন্মসহ দেশের প্রায় সব বয়সী মানুষই।
সোফিয়ারা যদি প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে বড় না হতো, তাহলে মহামারির এই সময় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কোনোভাবেই তাদের যুক্ত রাখা যেত না।
শুধু অনলাইন ক্লাসই নয়, এখন স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তির আবেদন অনলাইনে করা যাচ্ছে। সোফিয়ার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য সশরীরে কোথাও যেতে হয়নি। ঘরে বসেই ভর্তি হতে পেরেছে।
গত এক যুগে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যেন বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। পরিবর্তন এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবা খাতসহ তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। এখন মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৬০ লাখ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার।
করোনা মহামারির কারণে মানুষের ইন্টারনেট নির্ভরতা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে লকডাউন শুরুর পর থেকে। অনেক মানুষ ঘরে বসেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে, করছে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে। স্বাস্থ্যসেবাও নিচ্ছে অনলাইনে। টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের ডাক্তারি পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে।
শিল্পী সাহা এক জন ডায়াবেটিস রোগী। প্রতি মাসেই ডাক্তারের পরামর্শের প্রয়োজন তার। কিন্তু লকডাউনের সময় ঘর থেকে বের হওয়া সহজ ছিল না তার জন্য। টেলিমেডিসিন সেবা নিয়ে এখন ভালোই আছেন।
বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সালে। সে বছর দুটি ঘটনা ঘটেছিল। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা একটি দেশের ই-কমার্স খাতের অবস্থান নির্ণয়ের প্রধান সূচক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে এখন চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (ফোরজি) চালু রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে প্রায় ১১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যা বাংলাদেশের ই-কমার্সকে এনে দিয়েছে গতি। প্রতি মাসেই আসছে নতুন নতুন উদ্যোগের ওয়েবসাইট।
যদিও ই-কমার্সের ক্রেতারা মূলত শহরকেন্দ্রিক। ৮০% ক্রেতা ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের। এদের মধ্যে ৩৫% ঢাকার, ২৯% চট্টগ্রামের এবং ১৫% গাজীপুরের অধিবাসী। নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট শহরে আছে প্রায় ২০ শতাংশ ক্রেতা। ৭৫% ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪ বছরের মধ্যে।
আলু-পটলও যে অনলাইনে কেনা যায়, তা এই করোনাকাল শিখিয়েছে দেশের মানুষকে। বিশেষ করে রাজধানীবাসীকে। এখন অনেকেই অনলাইনে কাঁচাবাজার সারছেন, ওষুধ কিনছেন। অনলাইনে ইলেকট্রনিকস পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা শুরু হয়েছে অনেক আগেই।
যারা এতদিন গরুর হাটে গিয়ে শিং দেখে, দাঁত দেখে, সঙ্গে দু-একটা গুঁতো খেয়ে গরু কিনতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাদের একটা বড় অংশ এবারের ঈদে অনলাইনে গরু কিনে খুশি ছিলেন।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, বছরে বিক্রি হচ্ছে আট হাজার কোটি টাকার পণ্য। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছোটখাটো ব্যবসা করছেন অনেকেই।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সরকার যে রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিল, সেই ঘোষণার আলোকে এরই মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়েও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে গেছে।
মোবাইলে মানি ট্রান্সফার, বিমানের টিকিট সংগ্রহ করা যাচ্ছে। টেন্ডারে অংশ নেয়া যাচ্ছে অনলাইনে। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব সেবা বহু মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও মানুষ দ্রুততম সময়ে মোবাইলে টাকা পাঠাতে পারছে। যেখানে ২০০৮ সালে দেশের অধিকাংশ মানুষ অপেক্ষায় থাকত বিদ্যুৎ আসবে কখন। শহরের মানুষও বিরক্ত ছিল লোডশেডিং নিয়ে।
সরকারি সব দরপত্র এখন ই-টেন্ডারের মাধ্যমে পাওয়া যায়। দ্রুততম সময়ে কাজ পাওয়া যাচ্ছে। কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে যে ঢিমেতাল ছিল তাও কেটে গেছে অনেকটা।
২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ এই আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্রামের মানুষও যাতে প্রযুক্তিনির্ভর কাজে যুক্ত থাকতে পারে সে জন্য দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হচ্ছে। যেখানে ফাইভজি প্রযুক্তির হাত ধরেই আসবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিকস ও বিগ ডাটা অ্যানালাইসিসের মতো নানা কাজ। দেশে ব্লকচেইন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেবা নিয়ে কাজ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
তাদের তৈরি ইআরপি সফটওয়্যার মাদাগাস্কার, ফিজি ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ব্যবহার হচ্ছে। তারা থাইল্যান্ডের জন্য ব্লকচেইনের মতো প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছে। এ ধরনের প্রযুক্তি আগামী এক দশক রাজত্ব করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশে আইসিটি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা বেসিসের সদস্য এখন এক হাজার ৩০০টির বেশি। এর মধ্যে ৬০টি কোম্পানির শেয়ার রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের।
তবে দেশের সব কার্যক্রম ডিজিটাল হয়ে যাওয়ায় সাইবার সিকিউরিটির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল সব সেবাকে সঠিক নিরাপত্তা দেয়া না গেলে হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সম্প্রতি জানিয়েছেন, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস প্রোভাইডিং হাব হবে বাংলাদেশ। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তরুণ মেধাবীদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে নেয়া হবে নানা পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, দেশের মানুষ ডিজিটাল কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে। সরকার প্রায় দেড় হাজার সেবা অনলাইনে নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় সাইবার সিকিউরিটি অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইসিটি বিভাগ কাজ করছে। দেশের ব্যাংকিং, হেলথ, সিভিল এভিয়েশনসহ নানা খাতে নিরাপত্তা জোরদারে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি কাজ করছে।
পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে এক হাজার সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট তৈরি করা হবে। এতে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান, দেশে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে তরুণরা।