ব্যাংকের শেয়ারের দাম দল বেঁধে বাড়লেও তা ধরে রাখতে না পেরে পরের দিনই পতনের যে বিষয়টি এর আগে একাধিকবার ঘটেছে, তা আবারও দেখা গেল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। সব কটি ব্যাংকের শেয়ার দর বৃদ্ধির পরদিন দু-একটি বাদে কমে গেল সিংহভাগের দাম।
ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাপক দরপতন ঘটল আর্থিক খাতেও। দিনের প্রায় পুরোটা সময় উত্থান হলেও শেষ বেলায় বস্ত্র খাতেও দেখা গেল দরপতন। প্রকৌশল খাতেও দিনটি ভালো যায়নি।
সব মিলিয়ে উত্থানে থাকা পুঁজিবাজারে ছন্দপতন হলো। সকাল ১০টা থেকে লেনদেন শুরু হয়ে বেলা পৌনে একটা পর্যন্ত উত্থানে থাকলেও শেষ পৌনে দুই ঘণ্টায় বিক্রয়ের চাপে সূচকের পতন হলো।
দিন শেষে ১৫ পয়েন্টের পতনে সূচকের অবস্থান ৬ হাজার ৭৭১ পয়েন্ট। অবশ্য এক পর্যায়ে সূচক এখান থেকে ৫০ পয়েন্ট বেশি ছিল। লেনদেন শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে সূচক এক পর্যায়ে উঠে যায় ৬ হাজার ৮২১ পয়েন্টে। তখন আশা করা হচ্ছিল আরও একটি ঝলমলে দিন বুঝি এলো পুঁজিবাজারে।
তবে শেষ পর্যন্ত যত কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে, কমেছে তার প্রায় দেড় গুণ। দর সংশোধনের দিন লেনদেনও কমে গেছে।
দিন শেষে ১৩৮টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২১৬টির। অপরিবর্তিত ছিল বাকি ২০টির দর। লেনদেন নেমেছে আড়াই হাজার কোটি টাকার নিচে। হাতবদল হয়েছে ২ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল২ হাজার ৬৭৩ কোটি ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
চার কর্মদিবস পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের পতন হলো বাংক খাতের শেয়ারগুলো দর হারানোর কারণে
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে চাঙাভাবে মূল্য সূচক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলেও তার পুরোপুরি ছাপ নেই ব্যাংক খাতে।
সবচেয়ে বড় বাজার মূলধনের খাতটিতে শেয়ারের দাম একেবারে বাড়েনি এমন নয়। তবে কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ দিয়েছে এবং চলতি বছর যে হারে তারা আয় করেছে, শেয়ারপ্রতি যে সম্পদমূল্য আছে, এসবের বিবেচনায় শেয়ার দর অবমূল্যায়িত বলেই মত দিয়ে থাকেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।
এর ভিড়ে মাঝেমধ্যে ব্যাংকগুলোর শেয়ার দর দল বেঁধে বাড়ে, কিন্তু তা ধরে রাখা যায় না। গত ২৭ মে এক দিনে সব ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়ে যে অবস্থানে পৌঁছে, সেখান থেকে কমে লেনদেন হচ্ছে ২০টির মতো ব্যাংক। আর বেড়েছে ১০ থেকে ১২টির দর।
অথচ চলতি বছর যে লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন, তা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত বলা যায়। করোনার বছরে ব্যাংকের আয় কমে আসবে- এমন আশঙ্কায় শেয়ার দর কমছিল, কিন্তু বছর শেষে দেখা যায়, আয় আসলে বেড়েছে। আর লভ্যাংশও বাড়িয়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক।
চলতি বছর অর্ধবার্ষিক মুনাফার যে হিসাব প্রকাশ হয়েছে, তাতেও আয়ে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংকের। কোনো কোনো ব্যাংকের আয় দ্বিগুণ হয়েছে, কোনোটির দেড় গুণ, কোনোটির আড়াই গুণ, কোনোটির তিন গুণ, কোনোটির প্রায় চার গুণ হয়েছে। এমন ব্যাংকও আছে, যেটি গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আয় করেছে এই সময়ে।
এর মধ্যেও ব্যাংকের শেয়ার দর যখন ঝিমোচ্ছে, তখন মঙ্গলবার ৩২টি ব্যাংকের মধ্যে লেনদেন হওয়া ৩১টিরই শেয়ার দর বেড়েছে। এর মধ্যে চারটির দাম বাড়ে দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। অর্থাৎ ১০ শতাংশ অথবা আশপাশে। ৫ থেকে ৯ শতাংশের আশপাশে দাম বাড়ে আরও বেশ কয়েকটির।
সেদিন লেনদেন স্থগিত থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক, টানা লোকসানে থাকা আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, নতুন তালিকাভুক্ত সাউথবাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের দর আজও বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। কিন্তু এর বাইরে কেবল ট্রাস্ট ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে ১০ পয়সা। কমেছে বাকি ২৮টির দর।
ব্যাংকের দল বেঁধে উত্থানের পর দিনই দল বেঁধে পতনের এই চিত্র এ খাতটি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি আর অনিশ্চয়তার বিষয়টিই সামনে নিয়ে এসেছে।
লোকসানি ব্যাংক টানা উত্থানে
ব্যাংক খাতের লাভজনক কোম্পানির আয় যখন আরও বাড়ছে, সে সময় দাম বাড়লে লোকসানি আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থাকাকাল ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ব্যাংকটি ২০০৬ সালে পুনর্গঠন করেও লাভের মুখ দেখতে না পারা ব্যাংকটি চলতি বছরেও লোকসানেই আছে।
করোনাকালে ব্যাংক খাতের মুনাফা ব্যাপক বাড়লেও আইসিবি ইসলামী নামে পরিচালিত ব্যাংকটি লোকসান কমাতে পারেনি এক পয়সাও। কিন্তু গত এক বছরে গোটা খাতের মধ্যে এই কোম্পানিটির শেয়ারদরই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
এই সময়ে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩ টাকা ২০ পয়সা। আজ দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৩০ পয়সা।
আগের দুই দিনের ধারাবাহিকতায় আজও ব্যাংকটি শেয়ারদর দিনের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে লেনেদেন শেষ করেছে।
নিয়মিত আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দিয়ে আসছে এমন পুরনো কোম্পানি ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার, এক্মিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, এনসিসি, ওয়ান ব্যাংকের দাম ছাড়িয়ে গেল নতুন তালিকাভুক্ত সাউথ বাংলার শেয়ারদর। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছুঁই ছুঁই দাম এখন এটির।
গত সপ্তাহে লেনদেন শুরুর পর থেকে টানা ৫ কর্মদিবস সর্বোচ্চ পরিমাণে বেড়ে দাম হয়ে গেছে ১৬ টাকা।
তৃতীয় যে ব্যাংকটির দাম দিনের সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে সেটি হলো এনবিএল। আগের দিন রেকর্ড ডেটের কারণে লেনদেন স্থগিত ছিল ব্যাংকটির। চলতি বছরের ঘোষিত লভ্যাংশ ৫ শতাংশ সমন্বয় হওয়ার পর শেয়ারের দাম হয় ৭ টাকা ৬০ পয়সা। সেখান থেকে এক দিনে বাড়ার সুযোগ ছিল ৭০ পয়সা। গোটা খাতে মন্দার দিন এই পরিমাণই বাড়ল দাম।
আর আগের দিন দল বেঁধে দাম বৃদ্ধির পরদিন দাম কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা কী হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা বোঝা যায় কিছু ব্যাংকের লেনেদেনে।
আগের দিন ৪০ পয়সা দাম বেড়েছিল এবি ব্যাংকের, আজ কমেছে ৬০ পয়সা। একই পরিমাণ দাম বেড়েছিল আল আরাফাহর। আজ কমেছে ১ টাকা ৩০ পয়সা।
ওয়ান ব্যাংকের দাম বেড়েছিল ৮০ পয়সা, আজ কমেছে ৬০ পয়সা। এনসিসির দাম বেড়িছিল ৭০ পয়সা, আজ কমেছে ৫০ পয়সা। ঢাকা ব্যাংকের দাম বেড়েছিল ৮০ পয়সা, আজ কমেছে ৪০ পয়সা। ইসলামী ব্যাংকে দাম বেড়েছিল ৯০ পয়সা, আজ কমেছে ৭০ পয়সা।
৪টি কোম্পানির দাম বৃদ্ধির ভিড়ে ২৮টির পতনের দিন লেনদেনও কমে গেছে। আগের দিন যেখানে হাতবদল হয়েছিল ৪৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, আজ হয়েছে ৩৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
ব্যাংকের মতোই চিত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এই খাত টানা দুই কর্মদিবস বাড়ার পর পতনও হলো দুই দিন।
খাতটির ২৩টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত। বাকিগুলোর মধ্যে তিনটির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১৮টির। লেনদেন নেমে এসেছে ২২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকায়। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ৩৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
দরপতন হয়েছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতেও। চলতি বছর রেকর্ড লভ্যাংশও এই খাতটিকে আকর্ষণীয় করতে পারেনি। ৩৬টি ফান্ডের মধ্যে দাম বেড়েছে কেবল ৫টির। পড়ে গেছে ২৫টির। আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি ৬টির দর। লেনদেনও কমে গেছে। হাতবদল হয়েছে ৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার ইউনিট। আগের দিন লেনদেন ছিল ৭৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার।
উজ্জ্বল দুই খাত
দরপতনের দিনটিতে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে গত জুন থেকে সংশোধনে থাকা বিমা খাত। টানা দুই দিন দাম বাড়ল এই খাতের শেয়ারগুলোর।
সবচেয়ে বেশি ১২ টাকা ১০ পয়সা বা ৮.৯৯ শতাংশ বেড়েছে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের দর। তবে দর বৃদ্ধি পাওয়া বাকি ৩৬টির হার খুব একটা বেশি নয়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর বেড়েছে ২.৯৪ আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা রূপালী লাইফের ২.৮৮ শতাংশ।
তবে শেয়ারদর বাড়লেও লেনদেন কমেছে। সব মিলিয়ে বিমা খাতে হাতবদল হয়েছে ১৬৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা যা আগের দিন ছিল ১৮৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
টানা এক বছর ঝিমুতে থাকা বিমা খাত সম্প্রতি যে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে, তার আরেকটি নমুনা দেখা গেল আজ।
এদিন সবচেয়ে বেশি দাম বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানির তালিকায় দুই নম্বরে উঠে আসে শাহজিবাজার পাওয়ার। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৯.৭৯ শতাংশ। এক দিনে এর চেয়ে বেশি বাড়ার সুযোগ ছিল না।
তবে টানা দুই দিন বৃদ্ধি পাওয়ার পর কমেছে কেপিসিএলের দর। সব মিলিয়ে ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৮টির। কমেছে ৫টির।
এই খাতে ব্যাপকভাবে বেড়েছে লেনদেন। আজ হাতবদল হয়েছে ২৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার। যা আগের দিন ছিল ১৫৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
অন্যান্য খাতের যে অবস্থা
আগের দিন দরপতন হওয়া বস্ত্র খাত বেলা একটা পর্যন্ত উজ্জ্বলই দেখাচ্ছিল। তবে শেষ দেড় ঘণ্টায় দাম পড়ে যায় শেয়ারের।
শেষ পর্যন্ত ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে দাম কমে যায় ৩৪টির। বাড়ে ১৭টির। আর অপরিবর্তিত থাকে বাকি ৭টির দর। লেনদেন কমেছে এই খাতেও। মোট হাতবদল হয়েছে ৩৭৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ৪০৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
ওষুধ ও রসায়ন খাতের শেয়ারে দেখা গেছে মিশ্র প্রবণতা। এই খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে লেনদেন স্থগিত একটির। বাকিগুলোর মধ্যে ১৩টির দাম বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১৬টির দর। আর অপরিবর্তিত ছিল একটির।
এই খাতে লেনদেনও বেড়েছে। সব মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ২৪১ কোটি ১৭ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ২১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে। এই খাতের ২০টি কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৮টির, কমেছে ৯টির, একটির লেনদেন স্থগিত ছিল। আর দুটির দাম ছিল অপরিবর্তিত।
লেনদেন হয়েছে মোট ৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
প্রকৌশল খাতে লেনদেন কমে গেছে। হাতবদল হয়েছে ২০১ কোটি ১০ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ২৫৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
এই খাতের ৪২টি কোম্পনির মধ্যে দাম বেড়েছে ১৫টির। কমেছে ২৭টির।
বিবিধ খাতের বড় মূলধনী কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের দাম বৃদ্ধি পাওয়া সূচকের বড় পতনের হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি এই খাতে লেনদেনও বাড়িয়েছে। আগের দিন শেয়ার দর কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছিল ১০১ টাকা ৭০ পয়সা। আজ সেটা বেড়ে হয়েছে ১০৫ টাকা ৬০ পয়সা। লেনদেনে যথারীতি সেরা এই কোম্পানিটিই। একটি কোম্পানিতেই লেনদেন হয়েছে ১৩০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এই খাতের ১৪টি কোম্পানির মধ্যে বেক্সিমকো ছাড়া বেড়েছে আর তিনটির দর। সব মিলিয়ে লেনদেন ১৭৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা।