পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের হিস্যা নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেছে সম্প্রতি। বিমা খাতের শেয়ারদর যখন ক্রমে বাড়ছিল, তখন জুনে চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ বা সিএসই প্রকাশ করে যে, এক মাসে কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
জানানো হয়, জুন শেষে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের ৩৬.৬২ শতাংশ ধারণ করে আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। মে মাস শেষে মোট শেয়ারের ১৬.৩৫ শতাংশ ছিল তাদের হাতে। ৩০ এপ্রিলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল ২২.১৯ শতাংশ শেয়ার। আর ৩১ মে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৯২ শতাংশ।
এই খবরে তেঁতে উঠে কোম্পানিটির শেয়ার দর। কিন্তু পরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পায় এই কোম্পানির শেয়ার উল্টো মে মাসে বিক্রি করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
এই হিসাব অনুযায়ী এপ্রিলে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের ১৬.৩৬ শতাংশ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। মে মাসে সেই শেয়ারের অর্ধেক বিক্রি করে দেন। মে শেষে তাদের হিস্যা ছিল ৮.০৮ শতাংশ।
এই বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর কোম্পানিটির শেয়ারদরে ধস নামে।
ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার সংখ্যার ভুল হিসাব নিয়ে অনলাইনে যে ব্যাপক প্রচার চলেছিল, প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, এটা বুঝি কারসাজি। কিন্তু পরে প্রকাশ পায় এটি চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ, তথা সিএসইর ভুল।
এটিই একমাত্র ভুল নয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তথা ডিএসইর সঙ্গে সিএসইর তথ্যে প্রায়ই হেরফের ঘটে।
ডিএসইতে প্রতি মাসের তথ্য নিয়মিত হালনাগাত করা হয় না। প্রায়ই দেখা যায় সিএসইতে হালনাগাত করা হয়, কিন্তু সে তথ্য থাকে ভুল।
রবির শেয়ারের হিসাব দুই মাস পর প্রকাশ পেয়েছে ডিএসইতে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিএসই প্রকাশ করেছে জুন ও জুলাই মাসের তথ্য। তাদের তথ্য অনুযায়ী জুলাইয়ের শেষে কোম্পানির শেয়ারের ১.৭৩ শতাংশ ছিল সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। জুন শেষে ছিল ১.৯২ শতাংশ।
তবে কিছুদিন আগে সিএসইর ওয়েসবাইট অনুযায়ী জুলাই শেষে দুই শতাংশের বেশি শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। তবে এখন তা সংশোধন করে জুন শেষে হিসাব রাখা হয়েছে। এখন আর জুলাই শেষে হিসাব দেয়া নেই।
রিং সাইন টেক্সটাইলে ডিএসইতে হিসাব আছে গত ডিসেম্বরের। হিসাব অনুযায়ী কোম্পানির শেয়ারের ১৬.২৩ শতাংশ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হিস্যা ০.০৫ শতাংশ আর ৫২.১৮ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
অন্যদিকে সিএসইতে আছে গত ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব। এতে বলা হচ্ছে কোম্পানির শেয়ারের ২০.৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, ০.১৩ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আর ৪৭.৮৩ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধারণ করে আছেন।
সিএসই এই হিসাব পেলে ডিএসই কেন পাবে না। আবার সিএসই রবি ও ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের সেই হিসাব কোথায় পেল- এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মনে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ দেয় না। কর্তা ব্যক্তিরা দায়সারা বক্তব্য দিয়ে থাকেন প্রশ্নের মুখে।
সম্প্রতি সময়ে পুঁজিবাজার বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। শেয়ার কারা বিক্রি করছে, আর কারা শেয়ার কিনছে তা নিয়ে প্রতিনিয়তই ঢু মারছে ডিএসই ও সিএসইতে।
প্রতি মাসের কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক, সাধারণ বিনিয়োগকারীসহ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণের তথ্য দেয়ার বিধান থাকলেও তারও কোনো সঠিক তথ্য নেই ডিএসই বা সিএসইর কাছে।
ডিএসইর উপমহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওয়েবসাইটে প্রতি মাসেই কোম্পানির তথ্য আপডেট করার বিধান আছে। তবে তা কোম্পানির পক্ষ থেকে পাওয়া সাপেক্ষে।’
সিএসইতে আপডেট থাকলেও ডিএসইতে কেন আপডেট থাকে না প্রশ্নে শফিকুর রহমান বলেন, ‘কোম্পানির যখন তথ্য প্রদান করে তখন ডিএসই ও সিএসই উভয় জায়গায় প্রেরণ করে। যদি ডিএসইতে আপডেট না থাকে তাহলে কোন কোন কোম্পানির ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে তা জানালে সংশ্লিষ্ট বিভাগে আমরা পাঠিয়ে দেব।’
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সিনিয়র অফিসার ও মুখপাত্র তানিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের কাছে কোম্পানি থেকে যে তথ্য আসে সেটি আপডেট করা হয়।’
তাহলে এত ভুল হয় কেন- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে, আমাদের কাছে নিউজ পাঠিয়ে দেন। আমরা ঠিক করে নিচ্ছি।’
এটি গণমাধ্যমের কাজ কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি একা বিষয়টা দেখি না। আমাদের একটি ডিপার্টমেন্ট আছে, যারা বিষয়টি দেখে।’
নিউজবাংলার প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব অবশ্য শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার এই বিষয়গুলোকে দুঃখজনক উল্লেখ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোন মাসে কার কাছে কত শেয়ার আছে তা দেখে অনেক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আর বিশেষ করে এ তথ্যগুলো কোম্পানির ফান্ডমেন্টালও প্রদর্শন করে।
‘কোনো মাসে প্রাতিষ্ঠানিকরা যখন শেয়ার বিক্রি করে দেয়, তখন সেটি দেখে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা এক ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। আবার যখন প্রাতিষ্ঠানিক বা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনে, তখন তারা আবার আরেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে এটি আপডেট রাখার জন্য ডিএসই ও সিএসইর অবশ্যই আরও আন্তরিক হওয়া উচিত।’
বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাতে বলেন, ‘কোম্পানির পক্ষ থেকে তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে ওয়েবসাইটে আপডেট করার নিয়ম আছে। তবে দুই ওয়েব সাইটে দুরকম তথ্য থাকার কথা নয়।’
কিন্তু এটা তো হচ্ছে- এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগেও কোম্পানিগুলোর মাসভিত্তিক তথ্য আপডেট করে কমিশনকে জানাতে ডিএসই ও সিএসইকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। প্রয়োজনে আবারও রিমাইন্ডার দিয়ে চিঠি দেয়া হবে।’
তথ্যে যত গরমিল
আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ শেষ হলেও ডিএসইতে খুলনা পাওয়ার প্লান্ট লিমিটেড-কেপিসিএলের শেয়ারের হিস্যার হিসাব আছে গত জুন মাসের হিসাব। এতে দেখানো হয়েছে, কোম্পানির শেয়ারের ০.৫২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক আর ০.০১ শতাংশ বিদেশি আর ২৯. ৪৮ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
তবে সিএসই হিসাব দিয়েছে জুলাই মাসের। সেখানে বলা হচ্ছে, এখন মোট শেয়ারের ৮.৪৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক, ০.২১ শতাংশ বিদেশি আর ২১.৩৫ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে।
এই তথ্য সঠিক হলে জুলাই মাসে ৩ কোটি ১৫ লাখের বেশি শেয়ার কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আর ৮ লাখের বেশি কিনেছে বিদেশি বিনিয়োগকারী।
কিন্তু ডিএসইর হিসাব বলছে, জুলাই মাসে কোম্পানির মোট শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৮০ লাখের কম আর ৫ লাখের বেশি সিএসইতে।
তাহলে শেয়ারের এমন হিস্যা কীভাবে হলো?- এমন প্রশ্নে সিএসই মুখপাত্র তানিয়া বেগম বলেন, ‘কোনো তথ্যে ভুল থাকলে সেটি জানালে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে জানাতে হবে।’
এমারেল্ড অয়েল কোম্পানির ক্ষেত্রেও জটিলতা আরো বড়। ডিএসই ও সিএসইতে জুন -জুলাই পর্যন্ত তথ্য থাকলেও তথ্যের আছে বড় গড়মিল।
ডিএসই বলছে, জুলাই মাসে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১২.০৬ শতাংশ শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৯.৬৮ শতাংশ।
অথচ সিএসই প্রকাশ করেছিল ২২.১৯ শতাংশ শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৩৯.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ শতাংশ শেয়ার জুলাইয়ে কিনেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
কিন্তু ডিএসইতে জুলাইয়ের হিসাব প্রকাশ করার পর সংশোধন করে সিএসই। এখন তারাও বলছে, মোট শেয়ারের ১২.০৬ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক আর ৪৯.৬৮ শতাংশ ধারণ করে আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের শেয়ারের হিস্যা নিয়ে ডিএসই বা সিএসই- কোথাও হালনাগাদ তথ্য নেই।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে কার কাছে কত শেয়ার আছে তার উল্লেখ আছে। অথচ এরপর আরও চারটি বছর কেটে গেছে।
ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের জুন মাস পর্যন্ত তথ্য আছে ডিএসইতে। আর জুলাই মাস পর্যন্ত তথ্য আছে সিএসইতে।
ডিএসই বলছে জুন মাসে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৪.১৬ শতাংশ শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৪৩.৯১ শতাংশ।
সিএসই বলছে, জুলাইয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে শেয়ারের ১৩.২৬ শতাংশ আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৪৪.৮১ শতাংশ।
দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই ফ্যামিটি টেক্সের হিসাব দেয়া আছে গত ৩১ মের। জুন ও জুলাইয়ের তথ্য এখনও হালনাগাদ করা হয়নি। এই তথ্য অনুযায়ী কোম্পানির শেয়ারের ১৮.৪১ শতাংশ আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আর ৭৭.৫৭ শতাংশ আছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
তাল্লু স্পিনিংয়ের বিষয়ে ডিএসইতে আছে জুন মাসের তথ্য। তবে জুলাই মাসের তথ্য প্রদর্শন করছে।
ডিএসইতে বলা আছে, জুন শেষে কোম্পানির মোট শেয়ারের ২১.৬৭ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে।
সিএসই বলছে, জুলাই শেষে শেয়ারের ২১.৪৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আর ৪৮.৩৯ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে।
মিথুন নিটিংয়ের শেয়ারের হিস্যা ডিএসইতে আছে জুন মাসের আর সিএসইতে জুলাই মাসের।
ডিএসই বলছে, জুন শেষে শেয়ারের ১৫.৩২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক আর ৬৭.৩২ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। আর সিএসই বলছে, জুলাই শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৫.৪৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৭.১৫ শতাংশ।