বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বন্ধ ও লোকসানি কোম্পানির খোঁজে বিনিয়োগকারীরা

  •    
  • ১৪ আগস্ট, ২০২১ ১৮:২৬

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশ কিছু বন্ধ, লোকসানি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে সেগুলোতে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে উৎপাদনে চলে আসে আলহাজ টেক্সটাইল ও রিংশাইন টেক্সটাইল। আর এমারেল্ড অয়েল আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। তিনটি কোম্পানি সফল হলেও যেগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ, সেগুলোরও শেয়ার দর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আবার বোর্ড পুনর্গঠন হয়নি, এমন লোকসানি ও বন্ধ কোম্পানির শেয়ারেও হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা।

কোনো সম্পদ নেই, উল্টো শেয়ারপ্রতি দায় ১১৩ টাকা ৬৩ পয়সা। কোম্পানির রিজার্ভে কোনো অর্থ নেই, উল্টো দায় ২ হাজার ৭৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি ১২৬ টাকা ৩৬ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের হিসাব এখনও প্রকাশ করেনি। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০ টাকার শেয়ারে লোকসান ছিল ১১ টাকা ৩৮ পয়সা।

এমন একটি কোম্পানিতে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। কিন্তু তৈরি হয়েছে এই আগ্রহ। জুলাই থেকে আর্থিক খাতের ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার দর বেড়েছে ৪৯.২০ শতাংশ।

৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি দাম ছিল ৬ টাকা ৩০ পয়সা। ১ থেকে ৪ জুন কোনো লেনদেনের রেকর্ড পাওয়া যায়নি। ৬ জুলাই কোম্পানিটির বোর্ড পুনর্গঠন করা হয় আর তার আগের কর্মদিবসে এক লাফে প্রায় ১০ শতাংশ দাম বেড়ে যায়। এরপর টানা বাড়তে বাড়তে দাম এখন ৯ টাকা ৪০ পয়সা।

অথচ গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেয়া ন্যাশনাল ব্যাংক বা এনবিএলের দাম এই ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কম। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকটি চাপে থাকলেও ২০২০ সালে ৩৬১ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে।

আলোচিত ব্যাংকার পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে ডুবেছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। একই ব্যাংকারের কারণে ডুবে যাওয়া ফাস ফিনান্সের দামও বেড়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতোই।

এই কোম্পানিটির বোর্ড পুনর্গঠন করা হয় গত ৩১ মার্চ। এই কোম্পানিটি ২০১৯ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১০ টাকা ১২ পয়সা। তখন শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য মাত্র ১ টাকা ৯৩ পয়সা। তবে এখন নিশ্চিতভাবেই তা ঋণাত্মকে চলে গেছে। কারণ, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ৮ টাকা ৫৪ পয়সা। কোম্পানির রিজার্ভে দায় আছে ১ হাজার ২০২ কোটি ৮০ লাখ টাকার।

এমন দুর্বল কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠনেও সে সময় দামে উল্লম্ফন হয়নি। বরং ১ এপ্রিল এই সংবাদ আসার দিন সকালে কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৪ টাকা ৭০ পয়সা। এক দিনে কমে যতটা সম্ভব ততটাই, ৪ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে।

কিন্তু এখন দাম ৮ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ এপ্রিল থেকে দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

একই দিন বোর্ড পুনর্গঠন করা লোকসানি ফারইস্ট ফিনান্সের শেয়ার মূল্য ছিল ৩ টাকা ৮০ পয়সা। কিন্তু দাম এখন ৮ টাকা ৯০ পয়সা। দাম হয়ে গেছে আড়াই গুণেরও বেশি।

তারও আগে ২২ জানুয়ারি বোর্ড পুনর্গঠন করা বিআইএফসি ২০১৮ সালের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক বিবরণীই এখনও প্রকাশ করেনি। ২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি ৬৯ টাকা ৫৫ পয়সা লোকসান, ৬৬ টাকা ৪০ পয়সা দায়, ৭৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণাত্মক রিজার্ভ থাকা কোম্পানিটি ২০১৮ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত কেবল হিসাব দিয়েছে। ২০১৮ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৪ টাকা ৭৯ পয়সা, আর শেয়ারপ্রতি দায় ছিল ৮৪ টাকা ২৪ পয়সা।

এমন দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দর বোর্ড পুনর্গঠনের আগের দিন ছিল ৪ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমান দাম ৭ টাকা।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশ কিছু বন্ধ, লোকসানি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে সেগুলোতে প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে উৎপাদনে চলে আসে আলহাজ টেক্সটাইল ও রিংশাইন টেক্সটাইল। আর এমারেল্ড অয়েল আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে।

কোম্পানিগুলো কখন বা আদৌ চালু হবে কি না, এ নিয়ে সংশয় ছিল। তবে এখন বিনিয়োগকারীরা তাদের হারানো পুঁজি ফিরে পাওয়ার আশায় আছেন।

কিন্তু বিএসইসির বোর্ড পুনর্গঠন মানেই যে সব কোম্পানি উৎপাদনে আসবে এমন নয়। কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এর আগে নিউজবাংলাকে বলেছেন, নতুন বোর্ড কোম্পানির দায়, দেনা, সম্পদের বিষয়টি বিবেচনা করে তা অবসায়নেরও সুপারিশ করতে পারে।

বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম নিউজবাংলাসহ কয়েকটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল ও ফ্যামিলি টেক্স নিয়ে তারা হতাশ। এগুলো আদৌ চালু করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। সে ক্ষেত্রে তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করবেন।

তবে এ বিষয়ে এখনো বিএসইসির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি আর তার আগেই শেয়ার মূল্য বেড়ে গেছে বহুগুণ।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এই দুটি কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিএসইসি। সেদিন সিঅ্যান্ডএর শেয়ার মূল্য ছিল ২ টাকা আর ফ্যামিলি টেক্সের ছিল ২ টাকা ৭০ পয়সা।

সিঅ্যান্ডএর শেয়ারের বর্তমান দাম ৬ টাকা ৭০ পয়সা, আর ফ্যামিলি টেক্সের ৫ টাকা ৭০ পয়সা। সর্বশেষ কর্মদিবসে সিঅ্যান্ডএর শেয়ার মূল্য বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। অন্যদিকে ফ্যামিলি টেক্সের শেয়ার মূল্য দিনে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়ার সুযোগ ছিল, বেড়েছে ৪০ পয়সা।

বোর্ড পুনর্গঠন বা মালিকানায় পরিবর্তন এলেই যে কোম্পানি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না, তার উদাহরণ পুঁজিবাজারেই আছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে পুনর্গঠন করে নতুন মালিকানা পরিবর্তন করেও ব্যাংকটিকে জাগানো সম্ভব হয়নি।

ব্যাংকটির পরিচালকদের মাধ্যমে ৬০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ডুবন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয় ২০০৬ সালের ১৯ জুন। ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর দুই বছর ধরে বেনামে থাকা শেয়ার বাজেয়াপ্ত করাসহ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় একটি পুনর্গঠন স্কিম তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ওই স্কিমের আওতায় ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ার মালয়েশিয়াভিত্তিক কোম্পানি আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিং এজি লিমিটেডের কাছে বিক্রি করা হয়। গত ১০ বছর ধরে এই গ্রুপের অধীনে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকটি। কিন্তু ১৩ বছরেও মুনাফার মুখ দেখেনি ব্যাংকটি। ফলে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক মুনাফায় যদি ফেরেও, তার পরেও তার ১ হাজার ৮৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকার দায় কবে পূরণ করবে, তার নেই কোনো নিশ্চয়তা। ফলে আপাতত লভ্যাংশ পাওয়ার আশা না করাই ভালো।

এই ব্যাংকটি ১৩ বছরেও লাভের মুখ দেখতে না পারলেও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফিনান্স বা ফারইস্ট ফিনান্সে কোন আশায় শেয়ার কিনছেন বিনিয়োগকারীরা, সে প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন।

বন্ধ, লোকসানি কোম্পানির দাম বাড়ল লাফিয়ে লাফিয়ে

এখন পুঁজিবাজারে এমন লোকসানি ও বন্ধ কোম্পানির জোয়ার। বোর্ড পুনর্গঠন হতে যাচ্ছে বা হয়েছে, এমন খবরেই সেই কোম্পানির শেয়ার নিয়ে তৈরি হচ্ছে হুলুস্থুল।

যেমন নুরানী ডায়িং। ২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৪১ পয়সা আর চলতি অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিক শেষে ৯৫ পয়সা লোকসান দেয়া কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ বলে গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে খবর আসে। সোমবার কোম্পানিটির শেয়ার মূল্য ছিল ১১ টাকা ৪০ পয়সা। দুই দিন টানা কমে বুধবার দাম দাঁড়ায় ৯ টাকা ৯০ পয়সা। আর দিন শেষে বিএসইসির বিজ্ঞপ্তি আসে কোম্পানিটির বোর্ড পুনর্গঠনে।

আর এ খবরে বৃহস্পতিবার আবার শেয়ার দর দেয় লাফ। সেদিন শেয়ার দর ৯০ পয়সা বাড়ার সুযোগ ছিল। বেড়েছেও তাই। আবার আতঙ্কে আগের দিন যত শেয়ার বিক্রি হয়েছিল, পরের দিন বিক্রি হয়েছে তার অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ দর আরও বাড়বে ভেবে তা ধরে রেখেছেন বিনিয়োগকারীরা।

বোর্ড পুনর্গঠন না হলেও আর্থিক খাতের লোকসানি ফার্স্ট ফিনান্সের শেয়ারদরও বাড়ছে তরতর করে।

২০২০ সালের চূড়ান্ত হিসাব এখনও প্রকাশ না করা কোম্পানিটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা। অথচ গত দুই কর্মদিবসে ৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে এনবিএলের সমান দাম ৮ টাকায় পৌঁছে গেছে। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য ছিল ৪ টাকা ৩০ পয়সা।

মালিকানা বদল দাম বাড়ার আরেক অনুষঙ্গ। গত বছর শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৬২ পয়সা ও ৩০ জুলাই সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ১ টাকা ২১ পয়সা লোকসান দেয়া বিবিধ খাতের মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দর বাড়ছে গত ১৩ জুলাই থেকে। সেদিন শেয়ার দর ছিল ৩১ টাকা ২০ পয়সা, বর্তমান দাম ৪৫ টাকা ২০ পয়সা।

কোম্পানিটি নতুন মালিকের অধীনে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে এবং এ খবরেই দামে এই ঊর্ধ্বগতি।

বস্ত্র খাতের তাল্লু স্পিনিংয়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই কোম্পানিটিরও মালিকানা বদলের গুঞ্জন আছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর লোকসান দেয়া কোম্পানিটি ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের হিসাবই দেয়নি।

কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়ছে গত ৫ এপ্রিল থেকে। সেদিন দর ছিল ৩ টাকা ৯০ পয়সা। বর্তমান দর ১১ টাকা ৫০ পয়সা। এর মধ্যে সবশেষ চার কর্মদিবসের মধ্যে তিনটিতে বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই। গত ৩ আগস্টও দাম ছিল ৭ টাকা ৯০ পয়সা। এরপর ৫ কর্মদিবসে বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

বস্ত্র খাতেরই আরেক কোম্পানি তুংহাই নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ২০১৭ সালের হিসাবই দেয়নি। কোম্পানিটি নিয়ে অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা। অথচ গত ৮ জুন থেকে দাম বেড়ে হয়ে গেছে আড়াই গুণ। সেদিন শেয়ার দর ছিল ৩ টাকা ২০ পয়সা। বর্তমান দর ৭ টাকা ৭০ পয়সা। তিন কর্মদিবসে দাম বেড়েছে ১৮.৪৬ শতাংশ।

মিথুন নিটিংয়ের দর গত ১ জুন ছিল ৯ টাকা ১০ পয়সা। বর্তমান দাম ১৮ টাকা। বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। এর মধ্যে গত ২৯ জুলাইয়ের পর সাত কর্মদিবসে বেড়েছে ৫ টাকা। এই কয়দিনেই বেড়েছে ২৭.৭৭ শতাংশ।

সরকারি লোকসানি কোম্পানির দাম মুনাফায় ডুবে থাকা কোম্পানির চেয়ে কম

প্রতিবছর আকর্ষণীয় মুনাফা করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পাওয়ার গ্রিডের চেয়ে বেশি দাম লোকসানে জর্জরিত সরকারি চিনিকল শ্যামপুর সুগারের। কেবল চার কর্মদিবসে ২৮.২৯ শতাংশ বেড়ে ৬২ টাকা ২০ পয়সার শেয়ার হয়ে গেছে ৭৯ টাকা ৮০ পয়সা।

আরেক চিনিকল জিলবাংলা সুগারের দাম গত চার বছরে শেয়ারপ্রতি সর্বনিম্ন ১৮ টাকা ১৩ পয়সা মুনাফা করা যমুনা অয়েলের প্রায় কাছাকাছি। অথচ গত বছর শেয়ারপ্রতি ৯৩ টাকার বেশি লোকসান দেয়া জিলবাংলা ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে আরও ৪৭ টাকা ৮ পয়সা লোকসান দিয়ে আছে।

যমুনা অয়েলের শেয়ার মূল্য ১৭৮ টাকা ৭০ পয়সা আর জিলবাংলার ১৬৯ টাকা ২০ পয়সা।

জিলবাংলার দাম গত ২৭ জুলাই থেকে বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।

এই দুটি কোম্পানিকে বিদেশি বিনিয়োগে আধুনিকায়ন করে চালুর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে সরকার আর কেবল এ খবরেই এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম।

অন্যদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকা সিভিও পেট্রোক্যামিকেলকে আবার কাঁচামাল কনডেনসেট সরবরাহে রাজি হয়েছে সরকার। আর এতে তারা উৎপাদন শুরু করতে পারবে।গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের সঙ্গে কাদামাটি ও জ্বালানি তেলে পরিপূর্ণ আরও যে উপাদানগুলো আসে, তাকে বলে কনডেনসেট আর সেখান থেকে ডিজেল ও আরও কিছু উপাদান পাওয়া যায়। সেগুলো আলাদা করে বিক্রি করত কোম্পানিটি।

২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে কোম্পানিতে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিপিবি। এরপর থেকে উৎপাদন বন্ধ তাদের। সম্প্রতি বিপিসির সঙ্গে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর সমঝোতা হয়েছে বলে খবর এসেছে। তবে এখনও আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি।

এই আলোচনা চলছে, এমন সংবাদে গত ২২ জুন থেকে দাম অল্প করে বাড়তে থাকে। সেদিন দাম ছিল ৮৩ টাকা ২০ পয়সা। আর সমঝোতা হওয়ার আগে ২ আগস্ট দাম ছিল ১১১ টাকা ৯০ পয়সা। সেখান থেকে মাত্র ছয় কর্মদিবসে দাম পৌঁছেছে ১৫৫ টাকা ৫০ পয়সা। এই কয়দিনেই বেড়েছে ৩৮.৯৬ শতাংশ।

উৎপাদন শুরুর আলোচনা থাকা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিডি ওয়েল্ডিংয়ের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা যায় গত ৬ ‍জুন থেকে। সেদিন দাম ছিল ১৫ টাকা ৭০ পয়সা। বর্তমান দাম ২৩ টাকা। এই কয় দিনে বেড়েছে ৪৬.৪৯ শতাংশ।

আরেক লোকসানি কোম্পানি জুট স্পিনার্সের পরিচালনা পর্ষদকে গত ২৫ মে আরও ১০টি কোম্পানির সঙ্গে তলব করে বিএসইসি। তলব করার দিন শেয়ার দর ছিল ৯৮ টাকা। বর্তমান দাম ১৫৮ টাকা। বেড়েছে ৬০ টাকা বা ৬১.২২ শতাংশ।

২০১২ সালের পর থেকে লোকসানের কারণে কখনও লভ্যাংশ দিতে না পারা কোম্পানিটি গত মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিক শেষে শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ৩৩ টাকা ৮৩ পয়সা। গত বছরে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ১৪৭ টাকা ৪৪ পয়সা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ

ঝুঁকি কোথায়

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিনিয়োগকারীরা এসব জাংক শেয়ারে অতি নির্ভরশীল হলে দুটি ক্ষতি হতে পারে। উচ্চমূল্যে যারা শেয়ার কিনে থাকেন, পরে তারা দাম কমতে থাকলে লোকসান দিয়ে বের হতে পারেন না। বছর বছর লভ্যাংশ না আসায় এসব শেয়ার কম দামে কিনেই সমন্বয় করতে হয়। আবার একবার দাম বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে দ্বিতীয়বার সেই প্রবণতা আসতে সময় লাগে।

দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক দাম কম হয় বলে মৌলভিত্তির ভালো কোম্পানিবিমুখ হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। যারা ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন, তারাও ভাবতে থাকেন, এসব কোম্পানিতে থেকে কী লাভ। তার চেয়ে জাংক শেয়ারে বিনিয়োগ লাভজনক। এতে বাজারে দীর্ঘমেয়াদে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা যেভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেটিকে অস্বাভাবিক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বিনিয়োগকারীরা এখন ঢালাওভাবে লোকসানি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন। তবে তারা সেসব কোম্পানি থেকে মুনাফাও পাচ্ছেন। ফলে এসব কোম্পানির প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।’

এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা কী, সেটিও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। বলেন, ‘এ ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে লাস্ট বলটি যার হাতে থাকবে, তিনি লোকসানের মুখে পড়বেন।’

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নানা কারণে একটি কোম্পানি লোকসানি হতে পারে। অনেক কোম্পানি আছে যেগুলো পরবর্তী সময়ে মুনাফা বা উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দুই ধরনের কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করেছে। এখন বিনিয়োগকারীদের দেখতে হবে এর মধ্যে কোন কোম্পানিগুলো উৎপাদনে গিয়ে লোকসান কাটানোর সম্ভাবনা আছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন বিএসইসি লোকসানি কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করে দিচ্ছে, কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া বিনিয়োগকারীরা সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে একসময় তাই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হবে।

‘দুর্বল নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেগুলো আছে সেগুলো অন্যান্য যেকোনো কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই ঝুঁকি থেকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতেই বিএসইসি সম্প্রতি এসব প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির শেয়ার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, যা এসব কোম্পানিতে ঢালাও বিনিয়োগ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে।’

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই সম্প্রতি কিছু কোম্পানির দর বৃদ্ধি তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে এমন কোম্পানিও আছে, যেগুলোর বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছে কমিশন।’

এ বিভাগের আরো খবর