পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড বা কেপিসিএলের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর এই কোম্পানির শেয়ার আবার কিনছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
গত মে মাসের শেষে ১৫৫ মেগাওয়াটের দুটি কেন্দ্রের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই অবশ্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দুটি কেন্দ্র বিশেষ শর্তে নতুন করে অনুমোদন পাবে। আগের মতো বিদ্যুৎ না কিনলে কেন্দ্র বসিয়ে ভাড়া দেয়ার বদলে যতটুকু বিদ্যুৎ কেনা হবে, ততটুকুর জন্য টাকা পাবে তারা।
কিন্তু অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কিছুটা কম দামে হলেও শেয়ার বিক্রি করে দিতে চান বহুজন। ব্যক্তিশ্রেণি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
গত এপ্রিল শেষেও কোম্পানির মোট শেয়ারের ৯.২ শতাংশ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। আর ০.৩০ শতাংশ ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।
তবে মে ও জুন মাসে এই শেয়ারের প্রায় পুরোটাই বিক্রি করে দেয়া হয়।
৩০ মে শেষে কোম্পানির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমে দাঁড়ায় ১.৬৫ শতাংশ আর বিদেশি বিনিয়োগ কমে হয় ০.০২ শতাংশ।
জুন শেষে আরও কমে তাদের হিস্যা। ৩০ জুন শেষে কোম্পানির মোট শেয়ারের ০.৫২ শতাংশ থাকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। আর মে শেষে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে যত শেয়ার ছিল, তার অর্ধেকও বিক্রি করে দেয়া হয়। তখন মোট শেয়ারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হিস্যা ছিল ০.০১ শতাংশ।
এই পুরোটা সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারের মালিকানার হিস্যার সবশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে আগস্টে এসে মে ও জুনের তথ্য জানানো হয়। তবে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতি মাসে ঠিকই তথ্যগুলো আপডেট করা হয়েছে।
আগস্টের প্রায় অর্ধেকটা পেরিয়ে গেলেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এখনও জুলাইয়ের হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। তবে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে ঠিকই জুলাইয়ের হিসাব দেয়া আছে।
সেই তথ্য বলছে, এখন কেপিসিএলের মোট শেয়ারের ৮.৪৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ধারণ করে আছে। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে ০.২১ শতাংশ।
৩৯৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিতে মোট শেয়ার সংখ্যা ৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ১৭৯টি।
এই হিসাবে জুলাই মাসে ৩ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৬৫টি শেয়ার কিনেছে। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কিনেছে ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৮২৬টি।
অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মিলিয়ে এই মাসে কিনেছে মোট ৩ কোটি ২৩ লাখ ৯ হাজার ৬৯১টি শেয়ার।
আর আতঙ্কে এই শেয়ার বিক্রি করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে ফাইল
কেপিসিএলের দুটি প্ল্যান্টের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সায় পাওয়ার পর সম্প্রতি তা পাঠানো হয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর তা পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। আর মন্ত্রণালয় সেটি চূড়ান্ত করে সরকারপ্রধানের দপ্তরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, সব সংস্থার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফাইলটি এখন একজন যুগ্ম সচিবের কাছে আছে। শাটডাউনের সময় জরুরি ও নিয়মিত ফাইল ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অন্য কোনো ফাইল পাঠানো হয়নি। তবে এটি যেকোনো দিন পাঠানোর মতো অবস্থায় আছে।
দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন অনুমোদনের বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত আছে কি না, এমন প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা বলেন, ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে ভিত্তিতে এটি অনুমোদনের বিষয়ে আগেই কথা হয়েছিল। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও এতে আপত্তি জানায়নি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এই পর্যায়ে ফাইল পাঠালে তা অনুমোদন না হওয়ার কারণ নেই।’
কেপিসিএলের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সোহরাব আলী খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্ল্যান্ট দুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে এখনও কোনো সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি প্ল্যান্ট দুটির মেয়াদ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি হচ্ছে জেনেছি। তবে আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কারা
পুঁজিবাজারে ব্যক্তিশ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা পাশাপাশি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে থাকেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারের তাদের সবচেয়ে দক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে দেখা হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হচ্ছে মূলত অনুমোদিত স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য বা ব্রোকারেজ হাউস। এ ছাড়া ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, কাস্টডিয়ান, ট্রাস্টি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক বা তফসিলি ব্যাংক পুঁজিবাজারে যে বিনিয়োগ করে থাকে, তাদেরও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কী বলছেন বিশ্লেষক
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানির শেয়ারের অংশ প্রতি মাসেই ওঠানামা করে। মুনাফা উত্তলনে হোক বা শেয়ার দর আগামীতে কমতে পারে, এমন আতঙ্ক থেকেও পুঁজিবাজারের বিভিন্ন শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়াতে পারে। ফলে শেয়ার বিক্রি বাড়লে তা কোনো না কোনো খাতে সেটি যুক্ত হবে।’
তিনি বলেন, ‘কেপিসিএলের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে, তা হলো অনিশ্চয়তা। কোম্পানিটির দুটি প্ল্যান্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ একটি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় মূলত সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করেছেন। আমি বলব, এটি তারা ভবিষ্যতে যাতে লোকসান না হয়, সে ভাবনা থেকেই বিক্রি করেছেন।’
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনলে সেটি ভালো কি না, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তারা যখন কোনো কোম্পানির শেয়ার বেশি করে কেনে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়, সেখানে মুনাফা আছে বলেই বিনিয়োগ করেছে।’
কেপিসিএলের আদ্যোপান্ত
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি হয় গড়ে ২১১ টাকায়। এটি যে মেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর তা বন্ধ হয়ে যাবে, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের কোনো ধারণা ছিল না।
কোম্পানিটির বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মোট তিনটি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে একটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বিষয়টি নিয়ে জানতে পারে।
এরপর থেকে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ে লভ্যাংশ পেয়ে আসছে বিনিয়োগকারীরা। এই দুটির মধ্যে ১১৫ মেগাওয়াটের কেপিসিএল-১-এর মেয়াদ শেষ হয় গত ৩১ মে। আর ৪০ মেগাওয়াটের নওয়াপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয় ২৮ মে।
গত ২০ মে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়াতে আমাদের চেষ্টা-তদবির অব্যাহত রয়েছে।’
মেয়াদ শেষে কেন্দ্র দুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই চেষ্টা তদবিরের কতটা আগাল, সে বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
কেপিসিএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র
তিনটি কেন্দ্রই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কোম্পানির মালিকানায় এখন আছে কেবল সহযোগী কোম্পানি ইউনাইটেড পায়রার ৩৫ শতাংশের মালিকানা।
পটুয়াখালীর খলিশাখালী এলাকায় ১৫০ মেগাওয়াটের এই কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে আগামী ১৫ বছর। এটি উৎপাদন শুরু করেছে গত ১৮ জানুয়ারি।
খুলনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কেপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্র
গত ৩১ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৯.২ শতাংশ শেয়ার ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের কাছে ছিল ২০.৫১ শতাংশ শেয়ার। আর দশমিক ৩০ শতাংশ আছে বিদেশিদের হাতে।