জুনে অর্থবছর শেষ হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মধ্যে প্রথম হিসেবে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড। প্রত্যাশা মতোই তারা রেকর্ড পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছ।
২০১২ সালে তালিকাভুক্ত ফান্ডটি তার ইউনিটধারীদেরকে ১৭.৫ শতাংশ, অর্থাৎ ইউনিট প্রতি ১ টাকা ৭৫ পয়সা করে লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে ইউনিটপ্রতি সর্বোচ্চ দেড় টাকা লভ্যাংশ দিয়েছিল তারা।
বুধবার ফান্ডটির ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় এই বিষয়টি অনুমোদন হয় বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
ফান্ডটি গত জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ১৪ পয়সা মুনাফা করেছে। গত বছর ইউনিটপ্রতি লোকসান ছিল ৭৬ পয়সা।
৩০ জুন ফান্ডটির ইউনিটপ্রতি সম্পদমূল্য ছিল ১৫ টাকা ৩২ পয়সা। আর বর্তমান দাম ১৮ টাকা ৫০ পয়সা।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধসের পর মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো প্রত্যাশিত মুনাফা দিতে না পারলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। গত এক বছরে পুঁজিবাজার চাঙা থাকায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ব্যাপক মুনাফা করেছে। আর এ কারণে এবার ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আশা করছেন ইউনিটধারীরা।
এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো যে হারে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে, তা চমকে দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। বেশিরভাগ ফান্ডে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারের চেয়ে বেশি হারে লভ্যাংশ পাওয়া গেছে।
এই অবস্থায় পুঁজিবাজারের ফান্ডগুলো কী লভ্যাংশ দেয়, সে দিকে দৃষ্টি ছিল। প্রথমে লভ্যাংশ ঘোষণা করা এই ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এই ফান্ডটির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বিনিয়োগকারীদেরকে আরও আশাবাদী করবে।
ফান্ডটি যে এবার ভালো লভ্যাংশ দেবে, সেটি স্পষ্ট ছিল আগেই। তৃতীয় প্রান্তিক শেষে তাদের আয় ছিল ২ টাকা ৯৬ পয়সা। তবে চতুর্থ প্রান্তিকে সূচক ৮৮০ পয়েন্ট বাড়লেও এই ফান্ডটি এই তিন মাসে তারা আয় করেছে ৩৬ পয়সা।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা অনুযায়ী যত আয় হয়, তার ৭০ শতাংশ এখন নগদে বিতরণ করতে হবে। তবে গ্রোথ ফান্ডের ক্ষেত্রে দেয়া যাবে ৫০ শতাংশ।
অবশ্য আগের বছর বাজারে ধসের কারণে বড় অংকের লোকসান দেয়ার কারণে তার বিরপীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের কারণে লভ্যাংশ কিছুটা কম হচ্ছে।
ফান্ডটির ইউনিটের বেশিরভাগ এখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে
এই ফান্ডটি গত বছর লোকসান না দিলে তাদের ৩ টাকা ১৪ পয়সা আয় থেকে ২ টাকা ২০ পয়সা লভ্যাংশ পেতে পারতেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু আগের লোকসানের কারণে ১ টাকা ২৮ পয়সার বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করার কারণে বাকি ১ টাকা ৮৬ পয়সার বিপরীতে লভ্যাংশ পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। আর চূড়ান্ত এই আয়ের ৯৪.০৯ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে।
লভ্যাংশ নিতে রেকর্ড ডেট ঠিক করা হয়েছে আগামী ২৯ আগস্ট। অর্থাৎ সেদিন যাদের হাতে ইউনিটটি থাকবে, তারাই লভ্যাংশ পাবেন।
এক সপ্তাহে আসছে ৫টির ঘোষণা, কেমন হতে পারে লভ্যাংশ
পুঁজিবাজারে বর্তমানে ৩৭টি ফান্ড তালিকাভুক্ত আছে। এর মধ্যে একটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় লেনদেন আছে ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে ৩৬টি ফান্ডের অর্থবছর শেষ হয়েছে জুনে।
এই ফান্ডগুলোর সিংহভাগই গত বছর লোকসানের কারণে লভ্যাংশ দিতে পারেনি। তবে এবার সেগুলো ব্যাপক মুনাফা করেছে তৃতীয় প্রান্তিক শেষে। আর চতুর্থ প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে ৮৮০ পয়েন্ট। এর সুফলও ফান্ডগুলো পাবে।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এলআর গ্লোবাল পরিচালিত গ্রিন ডেল্টা ফান্ড ও ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ট্রাস্টি বোর্ড সভা হবে বৃহস্পতিবার।
- আরও পড়ুন: মিউচ্যুয়াল ফান্ড: দিনবদলের আরও আভাস
গ্রিনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রথম তিন প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউনিটপ্রতি আয় করেছে প্রায় ৯৭.৯৮ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে তাদের ইউনিটপ্রতি লোকসান ছিল ১ টাকা ২ পয়সা।
ডিবিএইচ মিউচ্যুয়াল ফান্ড এই সময়ে ইউনিটপ্রতি আয় করেছে ১ টাকা ১০ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে ইউনিটপ্রতি লোকসান হয়েছিল ৯৯.৮৭ পয়সা।
অর্থাৎ এই দুটি ফান্ডকে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত চতুর্থ প্রান্তিকের মুনাফা কত হয়, তার ওপর নির্ভর করতে পারে লভ্যাংশ।
কারণ, আগের বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণের সুযোগ থাকছে। আর তিন প্রান্তিক শেষে দুটি ফান্ডের আয়ই আগের বছরের লোকসানের সমান।
ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পুঁজিবাজারে মোট দুটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড পরিচালনা করে। মেয়াদহীন আরও দুটি ফান্ড আছে তাদের
এসইএমএল আইবিবিএল শরিয়াহ ফান্ড আগামী ৮ আগস্ট বেলা দেড়টায় লভ্যাংশ ঘোষণাসংক্রান্ত সভা ডেকেছে।
এই ফান্ডটি গত মার্চে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৮১ পয়সা মুনাফা করেছে। এই ফান্ডটি গত বছর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান দিয়েছিল। সেই লোকসানের পুরোটা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করলেও এখনও হাতে থাকে ৬৮ পয়সা। সঙ্গে চতুর্থ প্রান্তিকের আয় হবে। আর সেটির ঘোষণা হবে লভ্যাংশ।
৯ আগস্ট ট্রাস্টি সভা করবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের পরিচালিত এসইএমএল লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড ও এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড।
এসইএমএল লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড চলতি বছর তিন প্রান্তিক শেষে ইউনিটপ্রতি আয় করেছে ২ টাকা ১৪ পয়সা। গত বছর ফান্ডটি ইউনিটপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১ টাকা ৭ পয়সা। এর পুরোটা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করলেও হাতে থাকে এক টাকা ৭ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হবে চতুর্থ প্রান্তিকে আয়। আর সেটার ৭০ শতাংশ পেতে পারেন ইউনিটধারীরা।
এসইএমএল এফবিএসএল গ্রোথ ফান্ড জুলাই থেকে মার্চ সময়ে তিন প্রান্তিক মিলিয়ে ইউনিটপ্রতি আয় (ইপিইউ) হয়েছে ১ টাকা ৫৮ পয়সা। গত বছর ফান্ডটি কোনো লোকসান দেয়নি। ফলে কোনো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে না। তবে তারা গ্রোথ ফান্ড বলে মোট আয়ের ৫০ শতাংশ বিতরণ করতে পারবে।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ আরও এক কারণে লাভজনক। অন্য যেকোনো লভ্যাংশের ওপর শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর কাটে সরকার। কিন্তু মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত।
পুঁজিবাজারের বাইরের ফান্ডগুলোর অভাবনীয় লভ্যাংশ
এখন পর্যন্ত অতালিকাভুক্ত যেসব ফান্ড লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ- আইসিবি পরিচালিত ইউনিট ফান্ড। এটি ইউনিটপ্রতি ৪২ টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে। ফান্ডটির সবশেষ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬১ টাকা।
তবে ফান্ডটি চাইলেই কেনা যায় না। আইসিবিতে গিয়ে আবেদন করে রাখতে হয়। কেউ বিক্রি করতে চাইলেই পাওয়া যায়, তবে বিক্রির পরিমাণ খুবই কম। আর একবারে কিনতে হয় ৫০ লাখ টাকার ফান্ড।
ব্যাপক লভ্যাংশ দিয়েছে এএএমএল ইউনিট ফান্ডও। তারা ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৪৩ টাকা আয় করে আড়াই টাকা লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফান্ডটির বর্তমান দাম ১৬ টাকা ৩ পয়সা।
এই হিসাবে দামের ১৫.৫৯ শতাংশই লভ্যাংশ হিসেবে পেয়ে গেছেন বিনিয়োগকারীরা। গত বছর ইউনিটের দাম ছিল আরও কম। যারা কমে কিনেছেন, তাদের ইউনিট মূল্যের তুলনায় লভ্যাংশ শতকরা হারে আরও বেশি হয়েছে।
শান্তার ফান্ড
শান্তা ফার্স্ট ইনকাম প্রোপার্টি ফান্ড ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৮ পয়সা আয় করে ২ টাকা ৫ পয়সা লভ্যাংশ দিয়েছে।
এই ফান্ডটির সবশেষ মূল্য ১৪ টাকা ৬৭ পয়সা। কেউ যদি এই দামেও ফান্ডটি কিনে থাকেন, তার পরেও তার লভ্যাংশ এসেছে ইউনিটমূল্যের ১৩.৯৭ শতাংশ।
আইডিএলসির ফান্ড
আইডিএলসি ব্যালেন্সড ফান্ড ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ১৭ পয়সা আয় করে দেড় টাকা লভ্যাংশ দিয়েছে।
ফান্ডটি গত বছরের লোকসানের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে লভ্যাংশ কম দিয়েছে।
ক্যাপিটেকের ফান্ড
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ক্যাপিটেক পরিচালিত মেয়াদহীন দুটি ফান্ডের মধ্যে ক্যাপিটেক পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এই ফান্ডটির সবশেষ ইউনিটমূল্য ১১ টাকা ৫৪ পয়সা।
পদ্মা প্রভিডেন্ট ফান্ডের শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড ৭ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ফান্ডটির বর্তমান ইউনিটমূল্য ১০ টাকা ৫৪ পয়সা। কেউ যদি এই দামে ইউনিট কিনে থাকেন, তাহলে তিনি মুনাফা অবশ্য কম পেয়েছেন; ৬.৬৪ শতাংশ। তবে এটিও বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেকোনো সঞ্চয়ী স্কিমের সুদ হারের চেয়ে বেশি।
পেনিনসুলার তিন ফান্ড
পেনিনসুলা ব্যালেন্সড ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ১৭ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ৭০ পয়সা হারে লভ্যাংশ দেয়ার কথা জানিয়েছে।
ফান্ডটির ইউনিটপ্রতি আয় হয় ২ টাকা ৩৯ পয়সা। গত বছর এই আয় ছিল ১৫ পয়সা।
পেনিনসুলা এএমসিএল বিডিবিএল ফান্ড ইউনিটপ্রতি আরও বেশি আয় কমে কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এই ফান্ডটির আয় হয়েছে ৪ টাকা ৮৩ পয়সা। তবে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ৫০ পয়সা।
এই ফান্ডটি আগের বছর ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৭ পয়সা লোকসান দিয়েছিল। আর সেই লোকসানের সঞ্চিতি সংরক্ষণের কারণে এবার তারা লভ্যাংশ দিয়েছে মূলত বাকি ২ টাকা ৭৬ পয়সার ওপর। এই হিসাবেই ঘোষণা করা হয়েছে লভ্যাংশ।
পেনিনসুলা সাধারণ বিমা করপোরেশন ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ১২ শতাংশ অর্থাৎ ১ টাকা ২০ পয়সা হারে লভ্যাংশ দেবে।
এই ফান্ডটি ইউনিটপ্রতি হয় ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। তবে গত বছর ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৩০ পয়সা লোকসান দেয়ার কারণে সেটি লোকসান সমন্বয় করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
ন্যাশনাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ফান্ড
আইবিবিএল ইসলামী ইউনিট ফান্ড ইউনিটধারীদেরকে ৯০ পয়সা করে লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
ফান্ডটির বর্তমান ইউনিটমূল্য ১০ টাকা ২৯ পয়সা, যেটি এক বছর আগে সর্বনিম্ন ৬ টাকা ৯২ পয়সাতেও কেনা গেছে।
গত বছর ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ১৫ পয়সা লোকসান দেয়া ফান্ডটি এবার ইউনিটপ্রতি মুনাফা করেছে ৪ টাকা ৪ পয়সা। আর আগের বছরের লোকসানের সঞ্চিতি সংরক্ষণের পর ইউনিটপ্রতি চূড়ান্ত আয় দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ২৮ পয়সা।