একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে পুঁজিবাজার যখন নতুন উচ্চতার দিকে যাবে বলে আশা বড় হচ্ছে, সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে হোঁচট।
করোনাকালে প্রণোদনার ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে পুঁজিবাজারে টাকা আসছে, এমন কথা বলা নেই। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন এসেছে যে, এই অর্থ এসেছে এই খাতেও।
আর এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দিন সোমবার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা গেছে অস্থিরতা। প্রধান খাতগুলোতে ঘটেছে দরপতন। আর এ কারণে ছয় কর্মদিবস পর পতন হলো মূল্য সূচকে। তবে বেড়েছে লেনদেন।
১২ জুলাই ৬ হাজার ২০৮ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ৬ হাজার ৪২৪ পয়েন্ট পুঁজিবাজার পৌঁছে ২৫ জুলাই। আজও লেনদেনের শুরুতেই সূচক বেড়ে যায়। কিন্তু ২ মিনিটও স্থায়ী হয়নি সেই উত্থান।
এক পর্যায়ে সূচক আগের দিনের চেয়ে ৩৫ পয়েন্ট কমে যায়। তবে শেষ বেলায় ক্রয় চাপে সেখান থেকে কিছুটা বাড়ার পর ৬ হাজার ৪০৪ পয়েন্টে শেষ হয় লেনদেন।
আগের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অফসাইট সুপারভিশন’ বিভাগের পর্যবেক্ষণে প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহারের চিত্র উঠে আসে। প্রণোদনার টাকা যাতে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না হয়, সে জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ নিরীক্ষা বিভাগকে যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
তবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার মনে করেন, পুঁজিবাজার প্রণোদনার টাকায় চাঙা হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সার্বিক যে অবস্থা তাতে প্রণোদনার টাকায় পুঁজিবাজার চাঙা করার প্রয়োজন নেই। বরং এ সময়ে পুঁজিবাজার চাঙা হওয়ার নানা কারণ আছে। এককভাবে শুধু প্রণোদনার টাকাকে পুঁজিবাজার চাঙা হওয়ার জন্য বলা ঠিক হবে না।’
প্রণোদনার টাকার উপযুক্ত ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় পুঁজিবাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব আছে কি না, এমন প্রশ্নে দেবব্রত বলেন, ‘কিছুটা প্রভাব তো অবশ্যই আছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা এমন নিদের্শনায় প্রভাবিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
সোমবার লেনদেনে কমেছে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর। কমেছে সূচক। পাশাপাশি ব্যাংক, বিমা, বস্ত্র, প্রকৌশল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের শেয়ারের দরও কমেছে।
সবচেয়ে বেশি চাঙা ওষুধ ও রসায়ন খান
দরপতনের দিন সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে। এই খাতের কোম্পানিগুলোকে কর অবকাশ দেয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর দিন খাতওয়ারি সবচেয়ে বেশি ১৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১০৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এই খাতের ৩১টি কোম্পানির মধ্যে একটির লেনদেন স্থগিত দীর্ঘদিন ধরে। বাকিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ২২টির, কমেছে কেবল ৮টির।
গ্লোবাল হ্যাভি কেমিক্যালস এর শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৮১ শতাংশ। এ ছাড়া লিব্রা ইনফিউশনের ৪.৫৯ শতাংশ, কেয়া কসমেটিকসের ৩.৪৯ শতাংশ, এমবি ফার্মার ৩.৪১ শতাংশ, কোহিনুর কেমিক্যালসের ২.৬০ শতাংশ এবং অরিয়ন ইনফিউশনের দর বেড়েছে ২.২৮ শতাংশ।
দর বৃদ্ধির পর দিনই ব্যাংক খাতে পতন
অর্ধবার্ষিকী মুনাফার হিসাবে একের এক ব্যাংকের চমক, দেড়গুণ, দুই গুণ এমনকি তিন গুণের বেশি মুনাফা করার খবরে এই খাত নিয়ে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, সেটিতে ছেদ পড়েছে। আগের দিন ৩১টি ব্যাংকের শেয়ারের মধ্যে ২৬টির দর বাড়লেও আজ উল্টো চিত্র।
মাত্র ছয়টি ব্যাংকের শেয়ার দর বেড়েছে। নয়টির দর ছিল অপরিবর্তিত। বাকি ১৬টির দর কমেছে।
দর বৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে এনআরবিসি ব্যাংক, যার দর বেড়েছে ৩.৫০ শতাংশ। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংকের ১.৯০ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার ১.০১ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের দশমিক ৭৪ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের দশমিক ৬০ শতাংশ এবং পূবালী ব্যাংকের দর বেড়েছে দশমিক ৩৯ শতাংশ।
দর পতন হওয়া ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২.১৭ শতাংশ কমেছে স্যোসাল ইসলামী ব্যাংকের। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর অর্ধবার্ষিকীতে তিন গুণের বেশি মুনাফা করার খবর প্রকাশের পর কমেছে প্রাইম ব্যাংকের শেয়ার দরও। এই ব্যাংকটি দর হারিয়েছে ২.১৫ শতাংশ।
এ ছাড়া ঢাকা ব্যাংকের ২.০৫ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ১.৪১ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১.২৫ শতাংশ, ইউনাইটেড কর্মাসিয়াল ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ১.২২ শতাংশ।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ১ শতাংশের কম।
এই খাতে দরপতন হলেও লেনদেন কমেনি। হাতবদল হয়েছে ১১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন ছিল ১১০ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডেও পতন
৩০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশ ঘোষণার আগে আগে পরপর দ্বিতীয় দিন দর হারালো এই খাত। অথচ ঈদের আগে অল্প অল্প করে এই খাতে দর বাড়ার পাশাপাশি দিনের লেনদেন একদিন ১৪০ কোটি এবং একদিন ২০৫ কোটি টাকা হয়েছিল।
গত জুলাই থেকে চলতি জুন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে দুই হাজার পয়েন্টের বেশি। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোও তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বেশ ভালো মুনাফার তথ্য দিয়েছে। আর চতুর্থ প্রান্তিকে ৮০০ পয়েন্টের বেশি সূচক বাড়ায় এই প্রান্তিকেও আকর্ষণীয় মুনাফার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
ফান্ডগুলো গত বছর লোকসান দেয়ায় যদি এবারের মুনাফা থেকে সঞ্চিতি সংরক্ষণও করে, তার পরেও বাকি মুনাফা বিতরণ করলে দামের তুলনায় লভ্যাংশ হতে পারে অপ্রত্যাশিত।
মোট ৩৭টি ফান্ডের মধ্যে একটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেটি বেমেয়াদি ফান্ডে রূপান্তর হয়েছে, বাকিগুলোর মধ্যে ৩০টি ফান্ড যে কোনো দিন লভ্যাংশ ঘোষণা সংক্রান্ত বৈঠকের খবর দিতে পারে।
এই অবস্থাতেও ৩৬টি ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ছয়টির, কমেছে ২১টির আর পাল্টায়নি ১০ টির।
সবচেয়ে বেশি ৪.৯২ শতাংশ দর হারিয়েছে আইসিবি এএমসিএল সেকেন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড। সিএপিএম বিডিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান-এর দর কমেছে ৩.৫০ শতাংশ। আইসবি এএমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর কমেছে ৩.০৯ শতাংশ।
এছাড়া সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামী মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ২.৫৮ শতাংশ, ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ২.১১ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক ফার্সাট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ২.০৮ শতাংশ এবং এসইএমএ লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ডের দর কমেছে ১.৫৭ শতাংশ।
অবশ্য দরপতন হলেও বেড়েছে লেনদেন। আজ হাতবদল হয়েছে ৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ফান্ড। আগের দিন লেনদেন ছিল ৬৭ কোটি ৬০ লাখ টাকার।
বিমা খাত আরও ধরাশায়ী
গত জুলাই থেকে জানুয়ারি, এরপর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত উত্থানের পর বিমা খাতে দর পতন থামছে না কোনো মতেই।
আগের দিনের মতোই ঢালাও পতন হয়েছে বিমার শেয়ারের।
৫১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৫টির, কমেছে ৩৪টির। বাকি দুটির শেয়ার দর আগের দিনের সমান আছে।
সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ৪.২৭ শতাংশ। সন্ধানী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ৪.২৫ শতাংশ।
সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৪.০৩ শতাংশ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ৩.৭৩ শতাংশ, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের ২.৮৫ শতাংশ, তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ২.৮৫ শতাংশ।
প্রগতি ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ২.২৮ শতাংশ থেকে ১.০৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এই খাতে লেনদেনও কিছুটা কমেছে। হাতবদল হয়েছে ১৩২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১৩৫ কোটি টাকা।
অন্যান্য খাতের চিত্র
ব্যাংক বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে চারটির। দর পাল্টায়নি পাঁচটির। দর কমেছে ১৩টির।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে ৫৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকার, যা আগের দিন ছিল ৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
প্রকৌশল খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৫টির। দর পাল্টায়নি দুটির। বাকি ২৫টি কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হাতবদল হয়েছে ১৬৪ কোটি টাকার, যা আগের দিন ছিল ১৪০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
ঈদের আগে আগে চাঙা থাকা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শেয়ারে এদিন বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে শেয়ারদর কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির। এই খাতের ২৩টি কোম্পানির মধ্যে দর ৭টির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১৬টির দর।
তবে লেনদেন আগের দিনের তুলনায় হয়েছে দ্বিগুণ। এই খাতে হাতবদল হয়েছে মোট ১৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, আগের দিন যা ছিল ৭১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক দাম কমেছে ৯টি খাতের। আর বেড়েছে ১১টির। আগের দিন ব্যাপক আগ্রহ থাকা ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির শেয়ার আজও সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া কোম্পানির মধ্যে তিন নম্বরে ছিল। তবে দাম কমেছে ২ টাকা।
এই খাতে লেনদেন হয়েছে মোট ৭৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
ঈদের আগে চাঙা থাকা বস্ত্র খাত আরও দর হারিয়েছে। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়ার পর এবার লোকসানি ও দুর্বল কোম্পানিতে দেখা দিয়েছে ভাটার টান।
এই খাতের ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে কেবল ১৫টির, কমেছে ৩৬টির আর অপরিবর্তিত ছিল বাকি সাতটির দর।
এই খাতে হাতবদল হয়েছে মোট ১০৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা আগের দিন ছিল ১০৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ২০ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০৪ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ৩.৫৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯০ পয়েন্টে। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ১৩ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩২২ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১১১টির, কমেছে ২২৯টির আর দর পাল্টায়নি ৩৪টির।
লেনদেন হয়েছে মোট ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএ্এসপিআই আগের দিনের তুলনায় ৫৬ দশমিক ৯৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৬১৬ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১০৮টির, কমেছে ১৫৫টির আর দর পাল্টায়নি ৪৪টির। সিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৫৯ কোটি টাকা।