গত ঈদের আগেই যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ে তা বাস্তব হচ্ছে। আর ২৮ পয়েন্ট সূচক বাড়লেই নতুন ইতিহাস রচনা করবে পুঁজিবাজার। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি নতুন সূচক ডিএসইএক্স চালুর পর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থায় ওঠেছে এই সূচক।
২০১৭ সালে ২৬ নভেম্বর ডিএসইএক্স সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৩৩৬ পয়েন্ট। এর ওপরে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি সূচক উঠে ৬ হাজার ৩১৮ পয়েন্টে।
২০১৩ সালের আগে ডিএসইএক্স সূচকের জায়গায় ছিল ডিজিইএন সূচক। এটির ২০১০ সালে সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৫ ডিসেম্বর ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট।
পুঁজিবাজারের সূচক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সব সময়ের। চলতি বছরের শুরুতে সূচক হর হামেশাই সাড়ে পাঁচ হাজারে উঠেছে। কিন্তু স্থায়ী হয়নি। মে মাসে যখন সাড়ে পাঁচ হাজারের সূচক এগিয়ে পাঁচ হাজার আটশ পর্যন্ত উঠল তখনই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার দেখা দিল ছয় হাজারের সূচক দেখার। সেটিও সত্য হলো।
২ জুন থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৮ কার্যদিবসে মাত্র দুই কার্যদিবস সূচক ৫ হাজার ৯শ পয়েন্টে নেমেছে। বাকি ২৬ কার্যদিবস ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগাকরীদের আস্থায় ৬ হাজার পয়েন্ট ধরে রেখেছে।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার প্রদ্বীপ জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে। নানা উদ্যোগ আর বিনিয়োগকাদের স্বার্থ রক্ষায় নেয়া সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আস্থার সঞ্চালন করেছে।
বিশেষ করে দুর্বল ও জেড ক্যাটাগরিরর কোম্পানিগুলোকে মূল ধারায় নিয়ে আসার যে উদ্যোগ তাতে এ খাতে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে।
ওটিসি মার্কেট থেকে কোম্পানিগুলোকে সরিয়ে পরিশোধিত মূলধনের ভিত্তিতে এসএমই ও অল্টানেটিভ বোর্ডে নেয়ার উদ্যোগও প্রশংসা দিয়েছে কমিশনকে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, সূচক পুঁজিবাজারের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেই বিনিয়োগকারীদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। তারা মূলত সূচকের উত্থান পতন দেখেই বেশি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
সূচক বাড়লেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। ফলে যত সর্বোচ্চ অবস্থানে যাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও তত বাড়বে। এজন্য অবশ্য কমিশনের উদ্যোগও যোগ করতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি হবে না। বিনিয়োগকারীদের সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও খেয়াল রাখতে হবে।
এদিন লেনদেনের শুরুতে সূচকের উত্থান পতন ছিল। লেনদেন শুরুর পর ১২ টা ১২ মিনিট পর্যন্ত সূচকের গতি কিছুটা মন্থর ছিল। এরপর টানা উত্থানে থাকে সূচক।
লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর বৃদ্ধিতে লেনদেন হয়েছে ১৭শ কোটি টাকার বেশি।
দর বেড়েছে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের
বৃহস্পতিবার লেনদেনে তালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো আবারও উত্থান দেখাল। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঝিমিয়ে দর বেড়েছে এ খাতের। তবে বৃহস্পতিবার লেনদেনে ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে মাত্র দুটির দর পাল্টায়নি। বাকি ৩৫টি ফান্ডের দর বেড়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে সিএপিএম বিডিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান, যার ইউনিট প্রতি দর বেড়েছে ৯.৯২ শতাংশ। ইউনিটি প্রতি দর ১৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা ৪০ পয়সা। তারপরেই আছে এসইএমএল এফবিএসএল গ্রোথ ফান্ড, যার ইউনিট প্রতি দর বেড়েছে ৭.৫৬ শতাংশ।
এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, যার ইউনিট প্রতি দর বেড়েছে ৫.৬২ শতাংশ। ইউনিট প্রতি দর ১৬ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ টাকা ৯০ পয়সা।
ফনিক্স ফিন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটি প্রতি দর বেড়েছে ৫.৫০ শতাংশ। ইউনিট প্রতি দর ১০ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা ৫০ পয়সা।
এসইএমএল লেকচার ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ডের ইউনিট প্রতি দর বেড়েছে ৪.৯১ শতাংশ। ইউটিন প্রতি দর ১২ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা।
গ্রীনডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট প্রতি দর বেড়েছে ৪.৪৯ শতাংশ। এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর বেড়েছে ৪.০৫ শতাংশ। আইসিবি এএমসিএল সেকেন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর বেড়েছে ৪.৩৯ শতাংশ।
বস্ত্র ও প্রকৌশলেই উত্থান
বৃহস্পতিবার লেনদেন বস্ত্র ও প্রকৌশল খাতের শেয়ারের দরও বেড়েছে। লেনদেন হওয়া এই কোম্পানির কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগ শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে এগিয়ে ছিল।
প্রকৌশল খাতের ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৯টির। দর কমেছে মাত্র তিনটির। এছাড়া বস্ত্র খাতের ৫৮টি কোম্পানির মধ্যে ৪৮টি কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে। কমেছে ৮টির। আর দর পাল্টায়নি দুটির।
দিনের সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধিতে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি দখল ছিল নগন্য। শীর্ষ দর বৃদ্ধির ২০টি কোম্পানির মধ্যে এ খাতের ছিল মাত্র দুটি কোম্পানি। এগুলো হচ্ছে বেঙ্গল উইসডম থার্মোপ্লাস্টিক লিমিটেড, যার শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৯.৭৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৮.৮৪ শতাংশ। এ ছাড়া, আফতাব অটো, বিডিথাই, ইস্টার্নক্যাবল কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে।
বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইনভয় টেক্সটাইল লিমিটডের শেয়ার দর বেড়েছে ৬.৪৫ শতাংশ। শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ৬.৪০ শতাংশ। তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল মিলের শেয়ার দর বেড়েছে ৪.৭৬ শতাংশ। নূরানী ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার লিমিটেডের শেয়ার দর বেড়েছে ২.০২ শতাংশ।
দর হারিয়েছে বিমা ও ব্যাংক
দর ফিরে পাওয়ার একদিন পর আবারও দর হারাল বিমা খাত। বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে বেশির ভাগ বিমা কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। লেনদেন হওয়া ৫১টি বিমা কোম্পানির মধ্যে এদিন দর বেড়েছে ২১টির। দর কমেছে ২৭ টির। দর পাল্টায়নি তিনটির। ফলে দর পতনের দিক দিয়ে বেশি দখলে ছিল এ খাত।
এদিন সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ২.৪২ শতাংশ। শেয়ার দর ১০২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১০০ টাকা ৩০ পয়সা।
ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ২.১৪ শতাংশ। শেয়ার দর ৭৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৭৭ টাকা ৫০ পয়সা।
প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১.৮৪ শতাংশ। জনতা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১.৮০ শতাংশ। কর্ণফুলী ইন্সুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১.৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১.৭৩ শতাংশ। সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর কমেছে ১.৩৭ শতাংশ।
বিমা খাতের তুলনায় দর পতনের দিক দিয়ে ব্যাংকের অবস্থান ছিল আরও বেশি। এদিন দিনের সবচেয়ে বেশি দর পতন হওয়া কোম্পানি ছিল ব্যাংক খাতের রূপালী ব্যাংক লিমিটেড, যার শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৭.৩৫ শতাংশ। এরপরই ছিল এনআরবিসি ব্যাংক, যার শেয়ার প্রতি দর কমেছে ৪.৯৩ শতাংশ। সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ২.৯৪ শতাংশ। ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার দর কমেছে ১.৩৭ শতাংশ। এদিন ব্যাংকটির শেয়ার দর ৫০ টাকা ৮০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৫০ টাকা ১০ পয়সা।
ফাস্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শেয়ার দর কমার হার ছিল এক শতাংশ থেকে দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত।
সূচক ও লেনদেন
ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৩৪ দশমিক ০২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৭ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস সূচক ৬ দশমিক ২৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৫৯ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক দশমিক ২০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৭৪ পয়েন্টে। এদিন ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৃহস্পতিবার দর বেড়েছে ২৭০টির। দর কমেছে ৭৯টির। দর পাল্টায়নি ২৬টির।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধানসূচক সিএএসপিআই আগের দিনের তুলনায় ১১৬ দশমিক ৬০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩১৮ পয়েন্টে।
এদিন লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বৃহস্পতিবার দর বেড়েছে ২২২টির। দর কমেছে ৭৫টির। অপরিবর্তি রয়েছে ২৪টির। লেনদেন হয়েছে মোট ৬৯ কোটি টাকা।