বিশ্বকাপ এখন শেষ প্রান্তে। লিগ পর্ব ও সেমিফাইনাল পর্বের খেলা শেষে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ফাইনালের মাধ্যমে টুর্নামেন্টের পরিসমাপ্তির প্রতীক্ষা। এ আসর শুরু হওয়ার আগে গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, এবারের টুর্নামেন্টে বোলাররা বেশি দাপট দেখাতে পারেন; বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে বোলারদের, কিন্তু কিছু ম্যাচে বোলারদের বিধ্বংসী রূপ দেখা গেলেও তাদের ছাপিয়ে আলো কেড়ে নিলেন কিন্তু ব্যাটাররাই।
এ বিশ্বকাপে টি-টোয়েন্টি স্টাইলের নতুন ধারার ব্যাটিং লক্ষ্য করেছি। পৃথিবীব্যাপী যেভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এর বড় প্রভাব এ ওয়ানডে বিশ্বকাপেও পড়েছে।
এ বিশ্বকাপে প্রচুর রান দেখেছি আমরা। বিশেষ করে লিগ পর্বে স্কোর বোর্ডে অনেক রান উঠেছে। হাই-স্কোরিং ম্যাচ হয়েছে অনেক। সাড়ে তিন শ, চার শ এমনকি চার শর বেশি রানের দলীয় স্কোর হয়েছে খুব সহজেই। বর্তমানে তিন শ রানের স্কোর যেন সবজি দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো সহজ ব্যাপার হয়ে গেছে।
হিসাব করলে দেখা যাবে, গত বিশ্বকাপে একটিও চার শ রানের স্কোর ছিল না। মাত্র তিনটি চার শর কাছাকাছি স্কোর হয়েছিল, কিন্তু এবার ৯টি চার শ রানের বেশি ও চার শর কাছাকাছি রানের স্কোর হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪২৮ রানের রেকর্ড স্কোর গড়েছে সাউথ আফ্রিকা।
হাই-স্কোরিং ম্যাচে রান তাড়া করে জয়ের দৃশ্যও দেখা গেছে বেশ। এ আসরে যে কটি দেড় শর বেশি ব্যক্তিগত রানের ইনিংস খেললেন ব্যাটাররা, তা অতীতের কোনো একক টুর্নামেন্টে দেখিনি, যার মধ্যে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরিটি ছিল সবার সেরা। শুধু তাই নয়, অতীতের অনেক দলীয় ও ব্যক্তিগত ব্যাটিং রেকর্ড ভেঙেছে এ আসরে। চার-ছক্কা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। দুইবার দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙা-গড়ার ঘটনা ঘটেছে। ৪০ বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করার কীর্তি গড়েন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
এর আগে এইডেন মারক্রাম ৪৯ বলে দ্রুততম সেঞ্চুরি পূরণ করার রেকর্ড গড়েছিলেন। এমন অসংখ্য রেকর্ডে নাম লেখান ব্যাটাররা। মোটকথা, এ বিশ্বকাপে খুবই নান্দনিক ব্যাটিং উপভোগ করছি আমরা। ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে স্বাগতিক ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা। মজার ব্যাপার হলো পাওয়ার ব্যাটিংয়ের দারুণ প্রদর্শনী দেখানো এই চারটি দলই কিন্তু সেমিফাইনালে খেলেছে।
এবারের বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ের ধারাটাই যেন বদলে দিয়েছে ভারত। প্রতি ম্যাচেই ইনিংসের শুরু থেকে খুবই মারমুখী হয়েছে ভারতীয় ওপেনাররা, যা অন্য দলগুলো দেখাতে সাহস পায়নি। ‘পাওয়ারফুল স্টার্ট’-এর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয় তারা। তাতে সফলও হয়।
দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ব্যাটিংয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করছেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তার নামের পাশে জমা পড়েছে সাড়ে পাঁচ শ রান। বিরাট কোহলি আছেন ফর্মের তুঙ্গে। আমার দেখা, এটি তার সেরা বিশ্বকাপ আসর।
প্রতি ম্যাচেই ব্যাটিংয়ে দক্ষতা দেখিয়ে টুর্নামেন্টের টপ স্কোরার এখন কোহলি। তিনটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি ফিফটির সুবাদে তার নামের পাশে এখন ৭১১ রান। বিশ্বকাপের একক আসরে কেউই এত রান আগে সংগ্রহ করতে পারেননি। কোহলির একটি বিশেষ গুণ হলো দল যখন চাপে থাকে, তখন খুবই ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি খাটিয়ে বল বুঝে বুঝে ব্যাট চালাতে দেখা যায় তাকে। তার ব্যাটিংয়ে খুঁত ধরা যায় না। কোহলির মতো ব্যাটার দলে থাকলে দলের অন্যদের সাহসও বেড়ে যায় বহুগুণে।
অন্যদিকে চোকার্স নামটি আত্মগত করে নেয়া সাউথ আফ্রিকা এবারও সেমিফাইনালের গণ্ডি পেরোতে পারেনি, তবে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ থেকেই আফ্রিকানরা বিস্ফোরক ব্যাটিং করে সবাইকে বাড়তি বিনোদন দিয়েছেন। কুইন্টন ডি কক সর্বোচ্চ চারটি সেঞ্চুরির ইনিংস খেলে ছয় শর কাছাকাছি রান করেন।
এবারের বিশ্বকাপে কিউই অলরাউন্ডার রাচিন রবীন্দ্র নিজেকে আলাদাভাবে মেলে ধরেছেন। তিনটি সেঞ্চুরি ও দুটি ফিফটির ইনিংস খেলে পাঁচ শর বেশি রান করেন। ড্যারেল মিচেলও ব্যাটিংয়ে আলো কেড়েছেন। সেমিফাইনালে চার দলের বাইরে ইংল্যান্ডের ডেভিড মালান রানে ছিলেন। দল বিধ্বস্ত হলেও মালান কিন্তু লম্বা রানের ইনিংস খেলেছেন। এ ছাড়া পাকিস্তানের রিজওয়ান, আফগানিস্তানের ইব্রাহিম জাদরান, শ্রীলঙ্কার সামারাবিক্রমা ভালো ব্যাটিং উপহার দেন।
আমি মনে করি, অন্য আসরের তুলনায় এবার ব্যাটারদের অনেক বেশি আগ্রাসী দেখা গেছে। ২২ গজের মধ্যে তাদের রুদ্ররূপ ধারণ করার পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমেই বলব, ভারতের উইকেট ব্যাটারদের হয়ে কথা বলছে। উইকেটে বোলারদের অসহায়ত্ব লুকানো যাবে না। মরা উইকেটে বলে টার্ন, সুইং সেই অর্থে পায়নি তারা। উইকেটে প্রত্যাশিত মুভমেন্ট ছিল না, যে কারণে বেশি সফল হতে পারেননি বোলাররা। ব্যাটাররা রান পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত বলব, এবার ব্যাটারদের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করেছি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলতে দেখা যায় ব্যাটারদের, যে কারণে মাত্র ৭০-৮০ বলেই দ্রুত সেঞ্চুরি হয়। আক্রমণাত্মক ব্যাটিং প্রবণতা প্রতিটি ব্যাটারের মধ্যে রয়েছে।
তৃতীয়ত বলব, নতুন নতুন শট খেলতে দেখেছি ব্যাটারদের। এ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস ম্যাচে একটি স্লোয়ার ডেলিভারিতে যেভাবে স্টাম্পের আউটসাইডের বল রিভার্স হুক করে ছক্কা হাঁকালেন ম্যাক্সওয়েল, তা ছিল মনোমুগ্ধকর। ডেভিড ওয়ার্নারের রিভার্স ফ্লিকও ছিল দেখার মতো। এই যে নিজেদের ভান্ডারে নতুন নতুন স্ট্রোক শট সংযোজন ব্যাটারদের, এটি তাদের এগিয়ে নিচ্ছে।
শেষের দিকে বলব, ডেথ ওভারে দক্ষ বোলারের অভাবে বেশি রান উঠছে। ভারতের জাসপ্রিত বুমরাহ ওভারের ছয়টি বলেই ধারাবাহিক ইয়র্কার দিতে পারেন, কিন্তু তার মতো এমন দক্ষ বোলার অন্য দলে দেখা যায় না খুব একটা।
কাগিসো রাবাদার কথা বলা হলেও ইয়র্কারে এতটা নিয়ন্ত্রণ নেই তার। ইয়র্কারের জন্য মিচেল স্টার্ক সম্ভাবনাময় হলেও তার ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে।
এবারের টুর্নামেন্টে পেসারদের মধ্যে মোহাম্মদ শামি খুবই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখাচ্ছেন। প্রতি ম্যাচেই যে হারে শিকার করছেন, তাতে তাকে বিশ্বকাপের ইতিহাসে ভারতের সর্বকালের সেরা পেসার বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না। মাত্র ছয়টি ম্যাচ খেলে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ২৩ উইকেট শিকারের রেকর্ড তার। সেমিফাইনালে ভারতের জয়ের মহানায়ক শামি। ৫৭ রান দিয়ে একাই ৭ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান এ ডানহাতি পেসার, তবে লিগ পর্বে পেসারদের ছাড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা শীর্ষ উইকেট-টেকার ছিলেন (২২টি)।
কার্যকারিতার দিক থেকে ভারতীয় পেসাররাই নৈপুণ্য দেখিয়ে যাচ্ছেন। শামি, জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজদের বল সামলাতে হিমশিম খেতে দেখেছি ব্যাটারদের। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার মদুশঙ্কা, পাকিস্তানের শাহিন শাহ আফ্রিদি, দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়ানসেন, দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা, অস্ট্রেলিয়ার হ্যাজলউড, নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্টরা বোলিংয়ে ভীতি ছড়ান।
স্পিনে জাম্পার সঙ্গে স্যান্টনার, জাদেজা, রশিদ খান, কুলদীপ, মহারাজরা ভালো বোলিং করে উইকেট শিকার করেন, তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বোলাররা বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিতে না পারলেও তাদের ভূমিকা অপরিসীম।