আর মাত্র ঘণ্টা দুইয়ের অপেক্ষা। এর পরই শুরু হতে চলেছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে বড় ম্যাচ, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। এবারের আসরের দুই ফাইনালিস্টের ব্যাপারে এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় ‘অদ্ভূত’।
গোটা মৌসুমে দাপটের সঙ্গে পারফর্ম করে আসার ম্যানচেস্টার সিটি ইতোমধ্যে প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ জিতে রয়েছে ট্রেবল জয়ের মুখে। অন্যদিকে কোনোমতে শেষ চারে থেকে লিগ শেষ করতে পারলেও ঘরোয়া দুটি শিরোপা জিতেছে ইন্টার। ফলে দুই দলের জন্যই রয়েছে ‘ট্রেবল’ জয়ের হাতছানি।
কাতারি মালিকানায় যাওয়ার পর থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে দল গঠন ও গত ছয় মৌসুমে পাঁচবারই লিগ জয় করলেও ইউরোপ সেরার এ মঞ্চে বারবার হোঁচট খেয়েছে সময়ের অন্যতম সেরা কোচ পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। তবে অন্য যে কোনো মৌসুমের তুলনায় এবার তার দলের অবস্থা ভিন্ন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখনও তেমন কোনো ভুলই করেননি গার্দিওলার শিষ্যরা। ফলে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদেরই ফেভারিট হিসেবে দেখছেন বেশিরভাগ ফুটবলবোদ্ধা।
অন্যদিকে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এবার ‘আন্ডারডগ’ হিসেবে ফাইনালে উঠেছে সিমোনে ইনজাগির ইন্তারনাৎসিওনালে (ইন্টার মিলান)। গ্রুপপর্বে বায়ার্ন মিউনিখ ও বার্সেলোনার মতো দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেও নকআউট পর্বে তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষের (পোর্তো, বেনফিকা, এসি মিলান) মোকাবিলা করে তারা এসেছে ফাইনালে।
আর নকআউট পর্বে লাইপসিগ, বায়ার্ন মিউনিখ ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে সিটি।
তবে আন্ডারডগ হলেও বেশকিছু ব্যাপারে ইন্টার মিলানের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সর্বশেষ ১২ ম্যাচের ১১টিতেই জিতেছে তারা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ছয় ম্যাচে অর্থাৎ নকআউট পর্বের ম্যাচগুলোতে মাত্র তিন গোল হজম করেছে সিমোনে ইনজাগির শিষ্যরা, সেটাও আবার মাত্র এক ম্যাচেই। জমাট রক্ষণ ও নির্ভরযোগ্য মাঝমাঠই তাদের এমন প্রাপ্তির কারণ।
ফাইনালের উত্তেজনা
শক্তিমত্তা আর ট্যাকটিকসে যতই পার্থক্যই থাক না কেন, ফাইনালে যে দল ভালো খেলবে, তারাই চ্যাম্পিয়ন হবে। আবার শুরুতে যে কোনো দল খারাপ খেলে গোল হজম করে বসলে তার খেসারত দিতে হতে পারে পুরো ম্যাচজুড়ে। সান্তিয়াগো বের্নাবেউতে প্রথমার্ধের খারাপ পারফর্ম্যান্স যেমন ভুগিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদকে, আজকের ম্যাচেও তা হতে পারে যে কোনো দলের ক্ষেত্রে।
ফাইনাল স্পেশালিস্ট ইনজাগি
ইন্টার মিলানকে তুলনামূলক দুর্বল ভাবা হলেও তাদের ডাগআউটে থাকবেন ইনজাগি। ২০১৬-১৭ মৌসুমে লাৎসিওর দায়িত্বে থাকা ৪৭ বছর বয়সী এ কোচ প্রথম কোপা ইতালিয়ার ফাইনাল হারেন। এর পর থেকে পরপর সাতটি ফাইনাল জিতেছে তার কোচিংয়ে থাকা দল। এ মৌসুমেই দুটি ঘরোয়া লিগের ফাইনালে উঠে দুটিতেই সফল তিনি। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে কী কৌশলে দলকে খেলাবেন, সেটা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে ‘ট্যাকটিকসের বস’ খ্যাত পেপ গার্দিওলার জন্য।
আবার রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচে দুর্দান্ত আর্লিং হালান্ডকে কৌশলের মারপ্যাঁচে আটকে রেখেছিলেন লস ব্লাংকোস বস কার্লো আনচেলত্তি। আজ রাতেও আরেক ইতালিয়ান কোচের মুখোমুখি হবেন স্প্যানিশ কোচ গার্দিওলা।
গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে নিজেদের সহজাত ফুটবলের পরিবর্তে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে হারার বদনাম রয়েছে সিটি বসের। আজ কী করবে তারা, সেটা সময়ই বলে দেবে।
সিটির পজেশন বনাম ইন্টারের কাউন্টার
পজেশন ধরে রেখে খেলতেই অভ্যস্ত জোসেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। এটাই গার্দিওলার খেলোয়াড়ি দর্শন। এর ফলও ইতিবাচক। পজেশন ধরে রেখে খেললে সহজেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, ভুলের সম্ভাবনা কমে যায় ও সুক্ষ্ম পরিকল্পনা করে ম্যাচে এগোনো যায়। সেটাই করবে সিটি।
কেভিন ডি ব্রুইনে ও আর্লিং হালান্ডের মতো ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন খেলোয়াড় থাকায় প্রতিপক্ষের একটি-দুটি ভুলকেও গতি আর পাসের নিপুণতায় কাজে লাগাতে সক্ষম স্কাই ব্লুজরা।
আবার ৩-২-৪-১ ফর্মেশনে খেলা সিটির দলে মিডফিল্ডারই থাকবে ৬ জন। ফলে মাঝমাঠের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ যে তাদের কাছেই থাকবে, তা আগে থেকেই বলে দেয়া যায়। আবার দলের প্রয়েজনে বের্নার্দো সিলভা ও জ্যাক গ্রিলিশ যেমন উইঙ্গার হয়ে উঠে ক্রস দেবেন বার বার, তেমনই মাঝমাঠ সামলানোর সময় নিচে নেমে গেলেও আক্রমণের সময় স্ট্রাইকিং-এন্ডে দেখা যাবে কেভিন ডি ব্রুইনে ও ইলকায় গুনডোগানকে। ফলে ৩-২-৪-১ ফর্মেশন থেকে কখন ৩-৪-৩-এ পরিবর্তন হয়ে যাবে, বুঝে তা সামলাতে ইন্টারের মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
অন্যদিকে ইন্টার মিলানের শক্তি তাদের মিডফিল্ডে। মার্সেলো ব্রোজোভিচ, নিকোলো বারেল্লা ও হাকান চালানোলুরা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত মিডফিল্ডার। ইউরোপিয়ান ফুটবলে তারকাখ্যাতি না জুটলেও ম্যাচ বাই ম্যাচ তাদের পারফরম্যান্স স্থিতিশীল। আবার মাঝ মাঠের দুই উইংয়ে থাকা ফেদেরিকো দিমারকো ও ডেনসেল ডুমফ্রিসও প্রতিভাবান খেলোয়াড়। দলের প্রয়োজনে নিচে নেমে পাঁচজনের শক্তিশালী রক্ষণ তৈরির পাশাপাশি মুহূর্তের মধ্যে কাউন্টারে গিয়ে উইঙ্গার হয়ে উঠতে পারেন যে কোনো সময়। আবার স্বাভাবিক খেলার সময় পাঁচজনের ডিফেন্স হয়ে খেলবেন তারা। ফলে ৩-৫-২ ফর্মেশনে খেললেও ম্যাচের প্রায় সবসময়ই ৫-৫-৪ দেখা যেতে পারে ইন্টার মিলানকে।
আবার বিশ্বকাপজয়ী লাউতারো মার্তিনেস ও এদিন জেকোর মতো অভিজ্ঞ ও ক্ষিপ্রগতির স্ট্রাইকাররা সুযোগ পেলে যে কোনো সময় বোকা বানিয়ে দিতে পারে সিটির রক্ষণকে। ব্রোজোভিচের মতো অভিজ্ঞ ও দক্ষ মিডফিল্ডারের একটি-দুটি চুলচেরা পাসেই বিপদ হয়ে যেতে পারে পেপ গার্দিওলার শিষ্যদের।
আর শুরুতে দুই-এক গোল দিয়ে দিতে পারলে, রক্ষণে ইন্টার কতটা শক্তিশালী, তা তো বার্সেলোনার সঙ্গের গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচেই ভালোভাবে জানান দিয়েছে তারা।
তুরুপের তাস
তবে এদিন স্ট্রাইকাররা তেমন নজর কাড়তে না পারলেও দুই দলের দুই মিডফিল্ডার হতে পারেন তুরুপের তাস।
স্লো গেইম খেলতে খেলতে হঠাৎ করেই গতি পাল্টে প্রতিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়কে অতিক্রম করে থ্রু বল বাড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে সিটির বেলজিয়ান তারকা কেভিন ডি ব্রুইনের। আর সে থ্রু বল ধরে ফিনিশ করার জন্যই মূলত ম্যাচজুড়ে অপেক্ষা করবে আর্লিং হালান্ড। আবার ফলস্ নাইনে দক্ষতা দেখাতে পারেন কেভিন। গুনডোগান বা সিলভাবে সঙ্গে নিয়ে ওয়ান-টু-ওয়ান করে দুরের শটেও গোল করার দক্ষতা রয়েছে তার।
অন্যদিকে ইনজাগির ভরসার জায়গা ব্রোজোভিচ। ঠাণ্ডা মাথার এ মিডফিল্ডার যে কোনো সময় লং পাসে বল দিতে পারেন স্ট্রাইকারদের। সিটির পজেশনভিত্তিক খেলার মোড় ঘুরিয়ে যে কোনো সময় কাউন্টারে পাঠাতে পারেন তার স্কোরারদের।
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ফাইনাল। মাঠের খেলাই বলে দেবে, কারা উঁচু করে ধরবে ইউরোপিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নের শিরোপা; ম্যানচেস্টার সিটির আজীবনের, নাকি ইন্টার মিলানের ১২ বছরের অপেক্ষা ঘুচবে আজ।
স্কোর প্রেডিকশন: ম্যানচেস্টার সিটি ১-০ ইন্টার মিলান।