বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভবিষ্যৎ কী

  •    
  • ৪ মার্চ, ২০২৩ ০৯:০৯

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম নিয়ে বিসিবির ম্যানেজমেন্ট থেকে একটা সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, আমরা সেটা বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু এটা কী ব্যাপার, যারা পলিসি মেকিংয়ে আছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। এর বাইরে এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারব না।’

‘এখনই উইকেট ফেটে উঠছে। পানি দিতে হবে; রোলিং করতে হবে, কিন্তু রোলারসহ সব কিছু নিয়ে যাচ্ছে। বিসিবি যে হঠাৎ কী করল, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে লিগের খেলার ফাঁকে শুক্রবার সকালে এসব কথা বলছিলেন স্থানীয় ক্রিকেটার ফজলে রাব্বী।

সে সময় স্টেডিয়াম থেকে কাভার্ড ভ্যানে ঘাসকাটার মেশিনসহ বেশ কিছু সরঞ্জাম তুলতে দেখা যায়। মাঠের মাঝখানে স্থানীয় লিগের খেলা চলছে। এসব ছাপিয়ে স্টেডিয়ামজুড়ে যেন বিষাদময়তা।

ফজলে রাব্বী বলছিলেন, ‘এই উইকেট বাংলাদেশে একটাই। উইকেট নষ্ট হলে আবার বানানো অনেক কষ্টকর। হয়তো আর সম্ভব হবে না, কিন্তু এটা সত্যি আমাদের মতো নতুন খেলোয়াড়দের জন্য অনেক বড় সমস্যা।’

হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে গিয়ে উঠে এসেছে বিসিবি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার (ডিএসএ) পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। এসব পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বিপরীতে জেলার ক্রীড়ামোদিদের আক্ষেপ বাড়ছে।

তাদের ভাষ্য, এতদিন রাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক খেলা থেকে বঞ্চিত ছিল বগুড়াবাসী। এখন দুই সংস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বে দেশের অন্যতম সেরা শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামটি হারাতে বসেছেন তারা।

কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে এমন কাজ করেছে।

গত বুধবার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম থেকে নিজেদের ১৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যাহার করার বিষয়ে নির্দেশ দেয় বিসিবি। তাদের বিসিবির দেয়া মালামাল ঢাকায় মিরপুর স্টেডিয়ামে পাঠিয়ে দিতে বলা হয়।

পরের দিন বৃহস্পতিবার বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম হস্তান্তর প্রসঙ্গে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে বিসিবি একটি চিঠি দেয়।

বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সই করা এ চিঠিতে বলা হয়, ‘গত কয়েক বছর ধরে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অসহযোগিতার কারণে বিসিবি কর্তৃক কোনো টুর্নামেন্ট, লিগ আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে উক্ত স্টেডিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ কারণে এই ভেন্যুর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্য স্থানে বদলি করা হয়েছে।’

এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাতেই বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলনের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা জানি ২০০৭ সালে বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ভেন্যু থেকে বাতিল করে আইসিসি। এর পর থেকে বিসিবি নিজেদের লোকবল রেখে তাদের খেলা পরিচালনা করত, কিন্তু ১৬ বছরেও বিসিবি এখানকার কোনো উন্নয়ন, সংস্কার বা আন্তর্জাতিক মানের খেলা দিতে পারেনি। এ জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থা বিসিবির অসহযোগিতাকেই মূল কারণ বলে উল্লেখ করে।’

আন্তর্জাতিক খেলা না হলেও বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে দেশের সেরা উইকেট হিসেবে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) রেফারি ক্লাইভ লয়েড, পাকিস্তানের কিংবদন্তি সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরাম, শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনে, দলটির তারকা ব্যাটার তিলকারত্নে দিলশান, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার তাতেন্ডা তাইবুর মতো খেলোয়াড় স্টেডিয়ামটির উইকেটের প্রশংসা করেছেন।

ক্রিকেট বোদ্ধাদের দাবি, এই উইকেটে বাউন্স ভালো পাওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ম্যাচ না হওয়ায় স্টেডিয়ামের জৌলুস ফিকে হয়ে গেছে। সবগুলো গ্যালারিতে জমেছে শ্যাওলা। প্লাস্টিক চেয়ারগুলোয় ফাটল ধরেছে।

২০০৩-০৪ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকায় বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে (ফ্লাড-লাইটসহ) উন্নীত করা হয়। স্টেডিয়ামে চার টাওয়ারে ১০০টি করে ৪০০ ফ্লাড-লাইট রয়েছে।

এ লাইটগুলো ৮ লাখ ওয়াট বিদ্যুতের আলো সরবরাহ করতে পারে। আন্তর্জাতিক খেলা বন্ধের পরে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালানো হয়েছিল।এরপর সেগুলো আর জ্বলেনি। এর মধ্যে কোনো লাইট নষ্ট রয়েছে কি না, তাও বলতে পারেনি স্টেডিয়ামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। দূর থেকে দেখা যায় লাইটের সুইচ বক্সগুলো ফাঁকা পড়ে আছে।

সদ্য বদলি হওয়া ভেন্যু ম্যানেজার জামিলুর রহমান জামিল জানান, এ স্টেডিয়ামের উইকেট দেশের মধ্যে সেরা ও অন্যন্য। জাতীয় টিমের ও বিদেশি অনেক খেলোয়াড় এ উইকেটের প্রশংসা করে। মাঠটিতে অন্য কোনো খেলা হলে আইসিসির আইন অনুযায়ী আর হয়তো কখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

এই মাঠ যত্নের জন্য বিসিবি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিত। আর প্রতি মাসে গড়ে সোয়া লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করত।

শুক্রবার সকালে মাঠে ডিএসএর আয়োজনে প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ খেলা চলছিল। এই খেলার দায়িত্বে ছিলেন ডিএসএর কোষাধ্যক্ষ শামিম কামাল।

ওই সময় তিনি বলেন, ‘বিসিবি যে অভিযোগ করছে, তা কাল্পনিক। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানে বিসিবির খেলা হয়েছে। এরপর আমরা ১ মার্চে প্রিমিয়ার খেলায় তাদের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এরপর কী হলো? তারা এই সিদ্ধান্ত দেয়।’

শামিম কামাল বলেন, ‘তারা চলে যাবে যাক। স্টেডিয়ামে আগে ক্রিকেট খেলা হতো। এখনও হবে। ওরা ১৭ জন স্টাফ নিয়ে স্টেডিয়াম দেখাশোনা করত।

‘আমাদের চার থেকে পাঁচজন আছে, কিন্তু আমি আশা করি, মাঠ এমনিই রাখতে পারব।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে বিসিবির দ্বন্দ্ব বেশ কয়েক বছর ধরে। বিসিবি আয়োজিত বিভাগীয় টিমের খেলাসহ বিভিন্ন প্র্যাকটিস ম্যাচে বাধা দিয়ে আসছিল ডিএসএ। এমনকি খেলোয়াড়রা এলেও তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে, তবে এসব বিষয় নিয়ে সরাসরি কেউ মুখ খোলেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার চার খেলোয়াড় জানান, তাদের কাছে এমন অভিযোগ রয়েছে যে, গত বছর ইয়ুথ চ্যাম্পিয়ন লিগের প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলতে এসেছিলেন ক্রিকেটাররা, কিন্তু মাঠে নামার আগেই তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবারও ইয়ুথ চ্যাম্পিয়ন লিগের কেউ বগুড়ায় আসেননি।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সদস্য শাজাহান আলী বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে এমন অভিযোগ শুনে আসছি। ছেলেরা আসলে খেলতে দেয়া হতো না। ইয়ুথ চ্যাম্পিয়ন, বিভাগীয় খেলায় এসব করেছে, কিন্তু এখন তো আমরা সাবেক।

‘কিছু বলার নেই। শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভেন্যু আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। এটাই আমাদের ব্যর্থতা।’

বগুড়া ডিএসএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে যেটা হয়েছে, সেটা হলো দুই সংস্থার মান-অভিমান, কিন্তু মান-অভিমান থেকে কোনোদিন ভালো কিছু হয় না।

‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আশ্বাস দিয়েছেন এটা নিয়ে ঢাকায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।’

বিসিবি চলে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে বগুড়া ডিএসএর সাবেক সম্পাদক বলেন, ‘অনেকে মনে করতে পারে, বিসিবি চলে গেছে তো কী হয়েছে? আমরা চালাব।

‘চান্দু স্টেডিয়ামের পিচ ধরে রাখতে মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। এত সহজেই অন্যরা করতে পারবে? এটা নেশাখোরদের আড্ডা হবে। পুরোপুরি ভূতুড়ে মাঠ হয়ে যাবে।’

কর্মী প্রত্যাহারের বিষয়ে বগুড়ার সংবাদকর্মীদের কাছে বিস্তারিত কিছুই বলেনি বিসিবি কর্তৃপক্ষ।

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম নিয়ে বিসিবির ম্যানেজমেন্ট থেকে একটা সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে, আমরা সেটা বাস্তবায়ন করছি। কিন্তু এটা কী ব্যাপার, যারা পলিসি মেকিংয়ে আছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। এর বাইরে এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারব না।’

ডিএসএর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুরোটাই অস্বীকার করেন সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন।

তিনি বলেন, ‘গত মাসেও তো তারা খেলেছে। তাহলে অসহযোগিতা হলো কোথায়?’

মাসুদুর রহমান বলেন, “একটা কথা আছে, ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা।’ সবকিছুতেই যদি আমাদের বাঁকা চোখে দেখতে চায়, তাহলে কিছু করার নেই। আসলে আমরা বগুড়ার মানুষ বলে তারা আমাদের অবহেলা করে।”

হঠাৎ করে ভেন্যু বাতিল করার ঘটনাটিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন বগুড়ার পরিবেশ ও নাগরিক উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক কোনো খেলা দেখতে পারিনি। এখানে পুরোপুরি একটা রাজনৈতিক অবহেলা ছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর এবার কোনো কিছু না জানিয়ে হুট করে সব গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি বগুড়ার জন্য অপমানজনক।

‘আমরা হয়তো খেলার বিনোদন থেকে বঞ্চিত হব, কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েরা খেলোয়াড় হিসেবে সুদূরপ্রসারী সংকটে পড়বে।’

আব্দুল খালেক আরও বলেন, ‘তারা যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছে, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এই সিদ্ধান্ত একদিনে হয়নি। এখানে অবশ্যই কোনো ব্যক্তি-স্বার্থ আছে, যেটি খতিয়ে দেখা উচিত।

‘আর বিগত সময়ে স্টেডিয়াম এলাকায় যে জুয়া, লটারি, হাউজির রমরমা অবস্থা দেখা গেছে, মনে হচ্ছে সেটি আবার শুরু হবে।’

এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি, তবে বিষয়টি নিয়ে বিসিবিতে যোগাযোগ করবেন বলে জানিয়েছেন।

এ ছাড়াও বিসিবির ভেন্যু বাতিলের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে এআরসি স্পোর্টিং ক্লাবের আয়োজনে স্থানীয়রা মানববন্ধন করেন। ওই সময় তারা স্টেডিয়ামটি আবার বিসিবির কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করেন।

২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরে স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক টেস্ট ভেন্যুর স্বীকৃতিও পায়। অবশ্য এই মাঠে আগে থেকেই ভালো মানের পাঁচটি উইকেট (পিচ) রয়েছে।

২০০৬ সালের পর থেকে এ মাঠে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে কোনো খেলা উপভোগ করতে পারেননি দর্শক, তবে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় লিগ, স্থানীয় প্রিমিয়ার ডিভিশন, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও করপোরেট লিগ হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর