আর কিছু সময়ের অপেক্ষা। এরপরই উঠবে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ ফিফা বিশ্বকাপের পর্দা। ৩২ দলের অংশগ্রহণে এ মহাযজ্ঞ চলবে ২৮ দিন।
১৯৩০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর পর কেটে গেছে প্রায় ১০০ বছর। এ সময়ে দেখা মিলেছে তাক লাগানো কিছু পারফরম্যান্সের। পাওয়া গেছে বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি; হয়েছে অসংখ্য রেকর্ড।
চলুন একনজরে দেখে আসি ফুটবল বিশ্বকাপের সেরা পাঁচ গোল, যেগুলো ফুটবলপ্রেমীদের নজর কাড়বে আজীবন।
পেলে: ব্রাজিল বনাম সুইডেন, ১৯৫৮
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। সুইডেনের বিপক্ষে বৃষ্টিস্নাত সেই ম্যাচে সুইডেনকে হারিয়ে প্রথম শিরোপার স্বাদ নিয়েছিল সেলেসাওরা।
ম্যাচের শুরুতে গোল হজম করলেও প্রথমার্ধেই ২-১ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে অসাধারণ নৈপুণ্যে এক গোল করেন পেলে। চোখ ধাঁধানো সেই গোল আজও স্মৃতির মণিকোঠায় ফুটবল ভক্তদের।
সুইডিশদের সীমানায় নিলটন স্যান্টোসের ক্রস বুক দিয়ে রিসিভ করেন পেলে। সামনে দাঁড়ানো ডিফেন্ডার সিগ পারলিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেলে আলতোভাবে বলটি ক্লিক করে তার মাথার ওপর দিয়ে ছোট ডি-বক্সে ফেলেন। ডি বক্সে ফেলেই চোখের পলকে অবিশ্বাস্য এক সাইড ভলিতে সুইডিশ গোলরক্ষক সভেনসনকে পরাস্ত করেন পেলে।
সেই ম্যাচে ব্রাজিল জয় পেয়েছিল ৫-২ গোলে।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা: আর্জেন্টিনা বনাম ইংল্যান্ড, ১৯৮৬
১৯৮৬-এর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষ ম্যাচে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’-এর রেশ তখনও কাটেনি। তার আগেই তিনি ঘটিয়ে বসেছিলেন অনন্য এক কীর্তি। নজরকাড়া ড্রিবলিং ও অসাধারণ স্প্রিন্টে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ইংল্যান্ডের জালে আছড়ে পড়ে দ্বিতীয় গোল।
এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল তার গোলটি যে শেষ পর্যন্ত সেটি তকমা পায় ‘গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোলটির মালিকানা যদি কাউকে দিতে হয়, সেটি নিঃসন্দেহে যাবে ম্যারাডোনার ঝুলিতে।
দ্বিতীয়ার্ধের নবম মিনিটে অবিশ্বাস্য সেই গোলটি করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। নিজেদের সীমানার ভেতর থেকে হেক্টর এনরিকের পাস ধরে অসাধারণ স্প্রিন্টে মাত্র ১০ সেকেন্ডে ৬০ মিটার দৌড়ে পার হন ম্যারাডোনা।
পথে ড্রিবলিং নৈপুণ্যে কাটান হডল, রিড, স্যানসম বুচার আর ফেনউয়িককে। চার ফুটবলারকে কাটিয়ে ডি বক্সে ঢোকার পর তার প্রতিপক্ষ ছিল কেবল ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটন। দারুণ এক ভেলকিতে তাকেও বোকা বানিয়ে বাম পায়ের নিখুঁত শটে বল জালে জড়ান ম্যারাডোনা। আর তাতেই তিনি দিয়ে বসেন গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি।
ম্যারাডোনা: আর্জেন্টিনা বনাম বেলজিয়াম, ১৯৮৬
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপটা ছিল ম্যারাডোনাময়। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলের পাশাপাশি বিতর্কিত গোলটিও করেছিলেন তিনি। পরের ম্যাচেই (সেমিফাইনাল) বেলজিয়ামের বিপক্ষে আরও একটি তাক লাগানো গোল উপহার দেন তিনি, কিন্তু হ্যান্ড অফ গড আর গোল অফ দ্য সেঞ্চুরির কারণে অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায় তার এই গোলটি।
বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেমিফাইনালে দুই গোল করেন ম্যারাডোনা। আর দ্বিতীয় গোলটি করেন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে।
বেলজিয়ামের ডি বক্সের কাছেই কিছুটা ফাঁকায় দাঁড়িয়ে বলটা পেয়েছিলেন আর্জেন্টাইন দলপতি। বল পেয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা শতাব্দীর সেরা গোলের রেশ জাগিয়ে তুলে এক দৌড়ে বেলজিয়ামের ডিফেন্স লাইনে ঢুকে যান তিনি। দুর্দান্ত গতি ও অসাধারণ ড্রিবলিংয়ে বেলজিয়ামের তিন ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে বাম পায়ের জোরালো শটে খুঁজে নেন জালের ঠিকানা। বল জালে জড়ানোর পর বেলজিয়ামের গোলরক্ষক জা মেরি পাফের অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
গিওর্গি হ্যাজি: রোমানিয়া বনাম কলম্বিয়া, ১৯৯৪
১৯৯৪ বিশ্বকাপে নিজেদের ফুটবলে সেরা সময় পার করেছিল রোমানিয়া। সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের। গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যাওয়ার আগে গ্রুপপর্বে চোখ ধাঁধানো গোল উপহার দিয়েছিলেন রোমানিয়ার সাবেক তারকা ফরোয়ার্ড গিওর্গি হ্যাজি।
কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের ৩৫তম মিনিটে করা তার গোলটিকে বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল হিসেবে ধরে নেয়াই যায়।
বাম দিক থেকে কলম্বিয়ার অর্ধে উড়ে আসা বলটি রিসিভ করেন হ্যাজি। কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার লুই হেরেরার সামান্য বেখেয়ালি থাকার সুযোগ নিয়ে বল পেয়েই তিনি সোজা ঢুকে পড়েন ৩৫ মিটারের ভেতর। সেখান থেকে দূরপাল্লার অবিশ্বাস্য শটে পরাস্ত করেন কলম্বিয়ার গোলরক্ষক অস্কার কর্দোভাকে। বল জালে ঢোকার পর রীতিমতো বোকা বনে তাকিয়ে ছিলেন কর্দোভা। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না- এভাবেও গোল করা যায়।
মাইকেল ওয়েন: ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা, ১৯৯৮
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল আর্জেন্টিনার হাত ধরে। এক যুগ পর এসে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে সেই হারের ক্ষত লেপনের সুযোগ আসে ইংল্যান্ডের হাতে। সেই ক্ষত শুকাতে না পারলেও নজরকাড়া এক গোলে দলকে সমতায় এনেছিলেন ইংলিশ ফরোয়ার্ড মাইকেল ওয়েন। যদিও শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ইংল্যান্ড হেরে যায়, কিন্তু দুর্দান্ত সেই গোলটিকে ইতিহাসের সেরা দ্বিতীয় গোল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ফিফা।
সেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে পরিণত আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় নবীন দল ইংল্যান্ড। বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে মাঝমাঠের কাছাকাছি থেকে ডেভিড বেকহামের পাস রিসিভ করেন ওয়েন। তার সামনে ছিলেন তখন আর্জেন্টিনার দুজন মিডফিল্ডার।
নজরকাড়া ড্রিবলিংয়ে দুজনকেই কাটিয়ে ডি বক্সের দিকে এগিয়ে যান ওয়েন। ডি-বক্সের কাছাকাছি এসে হুট করেই কী যেন হয়ে যায় তার। অবিশ্বাস্যভাবে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে ঢুকে পড়েন ডি বক্সে। আর সেখান থেকে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক কার্লোস রোয়ার মাথার ওপর দিয়ে বল জালে জড়ান ওয়েন।
স্বাভাবিক গতি থেকে হুট করেই গতি বাড়িয়ে দিয়ে ব্যালেন্স ধরে রেখে যেভাবে তিনি গোল আদায় করে নিয়েছিলেন, সেটি প্রশংসার যোগ্য। আর সে কারণেই ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা গোলের কারিগর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।