প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে দুর্ভাবনায় গোটা পৃথিবী। সারা বিশ্বের সাগর-মহাসাগর দূষিত করে তুলছে প্লাস্টিক বর্জ্য। হুমকিতে পড়ছে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা। তবে এই বিভীষিকার অবসান সম্ভবত ঘটতে যাচ্ছে। আগামীর পৃথিবীতে দূষণ ঘটানোর পরিবর্তে মানুষের খাদ্যের উৎস হয়ে উঠতে পারে প্লাস্টিক।
বিজ্ঞানী স্টিফেন টেকটমান এমন এক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে কিছুটা সফলও হয়েছেন তিনি।
তবে বিষয়টি এমন নয় যে প্লাস্টিকের আসবাব বা খেলনা সরাসরি মুখে পুরে ফেলা যাবে। প্লাস্টিককে চূর্ণ করে বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে সুস্বাদু ও নিরাপদ খাদ্যে পরিণত করার গবেষণা চালাচ্ছেন টেকটমান।
ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের মতে, বছরে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টন। এসব বর্জ্যের শেষ ঠিকানা হয় সাগর-মহাসাগর। এই বর্জ্যের মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, তবে প্রক্রিয়াটি বেশ শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল।
মিশিগান টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ল্যাবে টেকটমান, শক্ত ‘হজমশক্তি’র কিছু ব্যাকটেরিয়াকে গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছেন। এই ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিককে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে ভোজ্য, প্রোটিন-সমৃদ্ধ উপজাতে পরিণত হয়।
টেকটমান বলেন, ‘ব্যাকটেরিয়া ও পরিবেশে এর ভূমিকা নিয়ে আমি সব সময় গবেষণা করেছি। জানার চেষ্টা করেছি, কীভাবে আমরা সমস্যা সমাধানে এদের ব্যবহার করতে পারি। আমি ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারের উপায় নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। এ সময়ে দেখেছি, প্লাস্টিক ও তেলের ক্ষেত্রে অনেক মিল রয়েছে। প্লাস্টিক কিন্তু আদতে তেল থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল।’
এর আগে আলকানিভোর্যাক্স বরকুমেনসিস প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারের কাজ করেছেন বিজ্ঞানীরা। টেকটমান পরে দেখার চেষ্টা করেন, এই ব্যাকটেরিয়ার ক্ষুধাকে প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় কিনা। প্লাস্টিককেও তারা খাবারে পরিণত করতে পারে কিনা।
টেকটমান বলেন, ‘আপনি যদি আণবিক পর্যায় থেকে ভাবেন তাহলে ব্যাকটেরিয়ার উপাদানের সঙ্গে আমাদের খাবারের খুব মিল রয়েছে। এগুলোতে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে। তা ছাড়া এরা লিপিড, চর্বি ও ভিটামিনসমৃদ্ধ। আমরা শেষে যে পণ্যটি তৈরি করছি তা অনেকটা প্রোটিন পাউডারের মতো। অবশিষ্ট অণুজীবের কোষগুলো আর জীবিত থাকে না। প্রোটিন ও লিপিড পাওয়ার জন্য আমরা তাদের ব্যবহার করছি।’
ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে প্লাস্টিককে খাদ্যে পরিণত করার প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক নাম বায়োলজিক্যাল প্লাস্টিক রি-ইউজ বাই ওলেফিন অ্যান্ড এস্টার ট্র্যান্সফরমিং ইঞ্জিনিয়ার্ড আইসোলেটস অ্যান্ড ন্যাচারাল কনসরটিয়া বা বায়োপ্রোটিন।
টেকটমানের দল এরই মধ্যে অল্প পরিমাণে খাবার উপযোগী প্রোটিন পাউডার তৈরি করতে পেরেছে। তবে এর স্বাদ এখনও কেউ পরীক্ষা করেনি। টেকটমান অবশ্য বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ান ভেজিমাইট স্প্রেডের মতো এটি খামির ও গন্ধযুক্ত।
পলি-ইথাইলিন (পিই), পলিপ্রোপাইলিন ও প্লাস্টিক বোতলে ব্যবহৃত পলিথাইলিন টেরেপথ্যালেটের মতো প্লাস্টিককে রাসায়নিকভাবে কয়েক ঘণ্টার জন্য চুল্লিতে প্রি-ট্রিট করতে হয়। পাখিরা অনেকটা এভাবে তাদের বাচ্চাদের জন্য খাবার চিবিয়ে দেয়। এতে প্লাস্টিক তৈলাক্ত খণ্ডে পরিণত হয়, আর ব্যাকটেরিয়াগুলো কয়েক দিনের মধ্যে তা দ্রুত হজম করে ফেলে।
প্লাস্টিকের ছোট খণ্ডগুলো সিউডোমোনাস ও রোডোকোকাসের মতো বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়াকে খাওয়ানো হয়। ব্যাকটেরিয়াগুলো এই বুফেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। এরা এমন কোষ তৈরি করে, যা প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রোটিন। সব প্লাস্টিক উদরপূর্তি করার পর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মানুষের খাওয়ার উপযোগী করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
টেকটমান বলেন, ‘এসব ব্যাকটেরিয়ার কোনোটি মানুষের কোনো রোগ সৃষ্টি করে না। আমরা যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করছি তাতে ব্যাকটেরিয়াকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করার আগে তাদের পাস্তুরিত করা হবে। এক কথায় বলা যায় রান্না করা হবে।’
টেকটমান ও তার দল আশা করছে, এই গবেষণার মাধ্যমে একই সঙ্গে ক্ষুধা ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যা সমাধানের পথ উন্মোচিত হবে।
এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কাজ করছি। আমরা এমন একটি খাদ্যপণ্য তৈরি করতে চাই, যা নিরাপদ। মাইক্রোবিয়াল বায়োমাসের নিরাপত্তা ও পুষ্টি উপাদান মূল্যায়ন করতে আমরা অনেকগুলো পরীক্ষা করছি।’
টেকটমান বলেন, ‘প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের একটি বড় সমস্যা। এর সমাধানে আসতে অনেক দক্ষতা, শক্তি ও প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সংকট মোকাবিলায় যদি ছোট কোনো অবদানও রাখতে পারি, সেটি হবে দারুণ এক্সাইটিং।’