চোখ দেখে মনের খবর পাওয়ার কথা গল্প-গানে বেশ প্রচলিত। এটি যে সত্যি তা বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও প্রমাণ হয়েছে। দেখা গেছে মানব মস্তিষ্কে বিভিন্ন চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়ে চোখের তারায়। আপনি কী কল্পনা করছেন, তার ওপর চোখের তারা বা পিউপিলের আকারের হেরফের ঘটে থাকে।
১৯৬০ সালের এক সন্ধ্যায় মনোবিজ্ঞানী একহার্ড হেস নিজের বাড়িতে চমৎকার কিছু প্রাণীর ছবির বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। স্ত্রী এ সময় হেসের চোখের তারা বড় হওয়ার বিষয়টি লক্ষ করেন। সাধারণভাবে মনে করা হয়, অন্ধকার পরিবেশে বেশি আলো গ্রহণের জন্য পিউপিলের আকার বড় হয়ে থাকে। তবে হেসের ঘরে তখন ছিল পর্যাপ্ত আলো।
এ ঘটনায় হেস ভাবতে থাকেন, আলো ছাড়া অন্য কোনো কারণেও পিউপিলের আকৃতি বদলাতে পারে। এর কারণ কী সেটা অনুসন্ধানে নামেন এই মনোবিজ্ঞানী।
পরদিন তিনি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর ল্যাবে তার সহকারীকে কিছু ছবি দেখান। শেষ ছবিটি ছিল অর্ধনগ্ন এক নারীর।
হেস বলেন, ‘আমি সপ্তম ছবিটা দেখানোর সময় লক্ষ্য করলাম তার চোখের তারা বড় হচ্ছে। এটা ছিল অর্ধনগ্ন নারীর ছবিটি।’
বিষয়টি নিয়ে হেস এরপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে চোখের তারার ও মানসিক অবস্থার গভীর সংযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনিসহ আরও অনেকের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে আমাদের চোখের তারা শুধু আলোক সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া হিসেবে আকার পরিবর্তন করে না, বরং মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের কারণেও পরিবর্তিত হয়। সক্রিয় আবেগ এমনকি মনে মনে উজ্জ্বল বস্তু বা অন্ধকার কিছু কল্পনা করলেও এ পরিবর্তন হতে পারে।
চোখের তারার এই বৈশিষ্ট্যকে সম্প্রতি নতুনভাবে পরীক্ষা করছেন বিজ্ঞানীরা।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোর একটি হলো ভয়। জন্মের পর থেকেই যে কয়েকটি সংবেদনশীলতার সঙ্গে পরিচিত হয় মানুষ, ভয় তার অন্যতম। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ এক মানসিক অবস্থার কারণে কিছু মানুষ কখনও ভয় পান না। এই অবস্থার নাম আফ্যান্টাসিয়া।
যারা এই বিশেষ মানসিক অবস্থায় ভোগেন তারা কল্পনা বা মনে মনে কোনো চিত্র তৈরি করার ক্ষমতা হারান। আর এই অবস্থা চিহ্নিত করার উপায় হিসেবে চোখের তারার আকার বিশ্লেষণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
বিজ্ঞান জার্নাল ই-লাইফে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাটি। আফ্যান্টাসিয়া আছে এবং আফ্যান্টাসিয়া নেই এমন একদল ব্যক্তিকে উজ্জ্বল এবং গাঢ় আকারের বস্তু কল্পনা করতে বলেন গবেষকেরা।
দেখা গেছে, যাদের আফ্যান্টাসিয়া নেই তারা কোনো উজ্জ্বল বা অন্ধকার বস্তু কল্পনা করার সময় চোখের তারা সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে আফ্যান্টাসিয়ায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি।
এই গবেষণা পরিষ্কার প্রমাণ দিচ্ছে, আমরা দেখার ওপরেই শুধু নয়, কল্পনার ভিত্তিতেও চোখের তারার আকারের হেরফের ঘটে থাকে।
গবেষণাপত্রের অন্যতম রচয়িতা ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ও নিউরোসায়েন্টিস্ট জোল পিয়ারসন বলেন, ‘চোখের রেটিনা আক্ষরিক অর্থেই মস্তিষ্কের অংশ। এটি মস্তিষ্কের এমন একটি অংশ যা দুনিয়ার সামনে উন্মুক্ত।’
নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিংগেনের এক্সপেরিমেন্টাল মনোবিজ্ঞানী সেবাস্টিয়ান মাটহোট পিউপিলোমেট্রি (চোখের তারা সংক্রান্ত বিদ্যা) নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন এটা অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন, শুধু আলো নয় অন্য অনেক কারণেই চোখের তারার আকৃতির পরিবর্তন ঘটতে পারে।’
মনোবিজ্ঞানী হেস আবিষ্কার করেছেন, কাউকে কঠিন গণিত সমাধান করতে দিলে চোখের তারা বড় হয়। অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেমান দেখেছেন, কিছু সংখ্যা মুখস্ত করতে বলার পর কিছু লোকের চোখের তারার আকার দেখে বোঝা যায়, তারা কতক্ষণ ধরে সংখ্যাটি মনে রাখছেন।
মাটহোট লিখেছেন, ‘বিষয়টা একদিক থেকে খুব সাধারণ। মনকে ক্রিয়াশীল করে এমন কোনো কিছুর কারণে চোখের তারার আকার বদল হয়।’
আফ্যান্টাসিয়া আক্রান্ত ফ্যান্টাসি ঔপন্যাসিক মার্ক লরেন্স ২০২০ সালে গার্ডিয়ানে লিখেছেন, ‘কল্পনাহীনতা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি এমন বই লিখি যা প্রায়ই স্পষ্ট ও উদ্দীপক দৃশ্য বর্ণনার জন্য প্রশংসিত।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আপনাকে একটা ঘোড়া কল্পনা করতে বলা হলে আপনি শুধু সেটিই দেখবেন। আমার কাছে এটা এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। একটা নির্দিষ্ট ঘোড়া দেখার বিষয়টির আবেদন অনেক কম। কারণ আমি যে ঘোড়াটি দেখতে চাইছি এটা দেখা না গেলে তখন কী হবে?’