মানুষের সামনে বিপুল রহস্য নিয়ে সীমাহীন বিস্তৃত হয়ে আছে মহাবিশ্ব। এখন পর্যন্ত বিশ্বজগতের অতি সামান্যই জেনেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিনিয়ত চলছে নতুন রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা।
তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিপুল যে বিশ্বজগতের রহস্যভেদের চেষ্টায় মানুষ দিশেহারা, তারই একটি ছোট সংস্করণ রয়েছে মানুষেরই মাথার ভেতরে!
মহাবিশ্বের এই ক্ষুদ্র সংস্করণটি হলো মানুষের মস্তিষ্ক।
শুধু গঠনের দিক থেকে নয়, সক্রিয়তার দিক থেকেও অদ্ভুত মিল রয়েছে মানব মস্তিষ্ক ও মহাবিশ্বের।
মহাবিশ্বের অগণিত ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির নেটওয়ার্ক যেভাবে কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের নেটওয়ার্কও ঠিক তেমন। ছায়াপথের সর্পিলাকার গড়নের (গোল্ডেন স্পাইরাল) সঙ্গে মিল রয়েছে মাথার ককলিয়ার।
কয়েক বছর ধরে যৌথ গবেষণাটি চালিয়েছেন ইতালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কো ভাজা এবং স্নায়ুশল্যবিদ আলবের্তো ফেলেত্তি। ফ্যাঙ্কো ভাজা ইতালির ইউনিভার্সিটি অফ বোলোনার সহযোগী অধ্যাপক, আর আলবের্তো ফেলেত্তি যুক্ত আছেন ইউনিভার্সিটি অফ ভেরোনার সঙ্গে।
‘দ্য কোয়ান্টেটিভ কমপেরিজন বিটুইন দ্য নিউরোনাল নেটওয়ার্ক অ্যান্ড দ্য কসমিক ওয়েভ’ শিরোনামে তাদের গবেষণা নিবন্ধটি গত ১৬ নভেম্বর ফ্রন্টিয়ার্স অফ ফিজিক্স জার্নালে প্রকাশিত হয়।
দুই গবেষক মানব মস্তিষ্ক এবং বিশ্বজগতের মতো প্রকৃতির সবচেয়ে জটিল দুটি ব্যবস্থাপনার তুলনা করেছেন। তারা দেখেছেন, মস্তিষ্কের নিউরোনাল নেটওয়ার্ক এবং মহাবিশ্বের ছায়াপথকেন্দ্রিক মহাজাগতিক নেটওয়ার্কের বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। এ দুটি ব্যবস্থার কাজের ধরনও অনেকটা এক।
একজন মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় মহাবিশ্বের আকার কয়েক শ কোটি গুণেরও বেশি। ফলে আকারের দিক থেকে কোনো তুলনায় যাননি গবেষকেরা। তারা খুঁজে দেখেছেন, গাঠনিক সাদৃশ্য।
গবেষকেরা বলছেন, মহাবিশ্ব এবং মানব মস্তিষ্কের কার্যক্রম একই ধরনের জটিলতা এবং স্বনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। দুটি ব্যবস্থার একদম উৎপত্তির জায়গাতেও আছে অনেক মিল। মস্তিষ্কের সেরিবেলামে প্রায় ৬৯ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে; অন্যদিকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাজাগতিক ওয়েবে ছায়াপথ একশ বিলিয়নের বেশি।
ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে তোলা মানব মস্তিষ্কের একাংশের ছবি (বায়ে), মহাবিশ্বে ছয়শ আলোকবর্ষ ব্যাপ্তির একটি অংশ
তুলনা করে দেখা গেছে, নিউরন ও ছায়াপথ- দুটি ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ ব্যাসার্ধ থাকে, যার মান গোটা ব্যবস্থার জালের একটি ভগ্নাংশ। তাছাড়া একেকটি নিউরন বা ছায়াপথের মধ্যে তথ্য ও শক্তির যে প্রবাহ রয়েছে, তার পরিমাণ গোটা ব্যবস্থার ভর ও শক্তির ২৫ শতাংশের কাছাকাছি।
মস্তিষ্ক ও মহাবিশ্বের গঠনের মধ্যেই রয়েছে নানান মিল। মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় ৭৭ ভাগই জলীয় উপাদান, আর মহাবিশ্বে প্রায় ৭২ শতাংশ হলো ডার্ক এনার্জি বা তমোশক্তি। এই দুই উপাদানকে দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় দেখালেও এরাই দুটি ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে বড় ভূমিকা রাখে।
দুটি ব্যবস্থাতেই জালের মতো দারুণ সুবিন্যন্ত নেটওয়ার্ক রয়েছে, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরন এবং মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।
গবেষক দলটি মহাবিশ্ব ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে থাকা জালের ধরনও বিশ্লেষণ করেছে। ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার ৭০০টি কসমিক ওয়েব পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মহাবিশ্ব জালের প্রতিটি সংযোগস্থল গড়ে ৩.৮টি থেকে ৪.১টি ওয়েব রয়েছে। অন্যদিকে মানব কর্টেক্সে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার নিউরন তন্তুজাল বিশ্লেষণে প্রতিটিতে সংযোগের গড় পাওয়া গেছে ৪.৬ থেকে ৫.৪টি।
গবেষণার ফলাফল জানিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কো বলেন, ‘আমরা দুটি ব্যবস্থার সর্পিল ঘনত্বের পরিমাপ করেছি। আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে সেরিবেলাম নিউরোনাল নেটওয়ার্কে বস্তুগত ঘনত্ব এক মাইক্রোমিটার থেকে ০.১ মিলিমিটারের মধ্যে। মহাজগতের ঘনত্বের আনুপাতিক হারও অনেকটা একই, যদিও বিপুল বিস্তৃতির কারণে সেখানে বস্তুগত ঘনত্ব পাঁচ মিলিয়ন থেকে ৫০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ।’
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানব মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি প্রায় ৪.৫ পেটাবাইট। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্কোর সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের জটিল কাঠামোর জন্য যে পরিমাণ মেমরি ক্ষমতা দরকার তার পরিমাণ প্রায় ৪.৩ পেটাবাইট।