বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম পেল জিআই পণ্য স্বীকৃতি

  • টাঙ্গাইল প্রতিনিধি    
  • ১২ অক্টোবর, ২০২৫ ০১:২৬

প্রবাদ রয়েছে- ‘চমচম, টমটম, শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি’। জেলার পোড়াবাড়ির চমচমের খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনে, পূজাপার্বণসহ সকল উৎসবে রসনাবিলাসীদের তৃপ্তি যোগাতে এই চমচমের উপস্থিতি সর্বত্র। শুধু নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও সেরা পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়িতে উৎপাদিত সেই বিখ্যাত চমচম বর্তমানে তার জন্মস্থানেই নিরুদ্দেশ হওয়ার পথে। টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টি পট্টিতে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম পাওয়া গেলেও খোদ পোড়াবাড়িতে অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। কালের বিবর্তনে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এখন মাত্র ৮-১০টি বাড়িতে চমচম তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে চমচম তৈরির বিখ্যাত কয়েকটি পরিবার ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুয়ায়ী টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।সরেজমিনে টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে পোড়াবাড়িতে পৌঁছি ইজিবাইকে চেপে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মস্থান সন্তোষ হয়ে দুইপাশের অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে পৌঁছাই পোড়াবাড়িতে। ধলেশ্বরীর শাখা নদী এ্যালনজানীর বামতীর ঘেঁষে সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি ইউনিয়ন তথা পোড়াবাড়ি গ্রাম। পোড়াবাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম হলেও ধলেশ্বরী নদীর তীরে গ্রামটি অবস্থিত হওয়ায় এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যে কাউকেই টানবে। তবে পোড়াবাড়ি বাজারে মিষ্টির দোকান টিকে রয়েছে মাত্র ৪টি।অন্যদিকে বেশি দুধের আশায় বিভিন্ন ধরনের বিদেশি গরু এখন পালন করেন স্থানীয় খামারিরা। ফলে দুধের সেই স্বাদও নেই। তারপরও প্রতিদিন পোড়াবাড়িতে দুধের বাজার বসে। ইতোপূর্বে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হলেও এখন তা কমে গিয়ে ১০০ মণে দাঁড়িয়েছে। দাম ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ঘোযরা এ বাজার থেকে গরুর খাঁটি দুধ কিনে নিয়ে যায় মিষ্টি তৈরি করার জন্য কারখানাগুলোতে।ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকেই টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজার ‘মিষ্টি পট্টী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোড়াবাড়ি গ্রামের গোড়াপত্তনের পেছনে মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ নিয়োজিত শাসক পীর শাহজামানের কৃতিত্ব ছিল। ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যে ইসলাম খাঁ কাগমারী পরগনার শাসনভার শাহ জামানের ওপর অর্পণ করেছিলেন। সে সময় চারাবাড়ীর গ্রামের দক্ষিণ অংশে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাজার ও বসতবাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে ওই এলাকাকে পোড়াবাড়ি বলা হত। ১৯৬০ সালে তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলে ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যসব জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে চমচমের সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।আরও জানা যায়, এ দেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল পোড়াবাড়ির চমচম। এদের মধ্যে রয়েছেন- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, যাদু সম্রাট পিসি সরকার, নবাব আলী চৌধুরী, জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরী প্রমুখ।পোড়াবাড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বর্তমানে খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে বর্তমানে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে জয় কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও গৌর ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এছাড়াও পাঁচআনি বাজারে অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। আর এ চমচম এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চায়না ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ কানাডা ইত্যাদি দেশে। আর মধ্যপাচে, দুবাই, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে অহরহ। পোড়াবাড়ির চমচম তৈরির বয়োবৃদ্ধ কারিগররা জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের আমল থেকে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোটবেলায় তারা এক হাড়ি দুধের দাম দুপয়সা থেকে ৪ পয়সায় বেচাকেনা করত। চিনি পাওয়া যেত ৩ আনা থেকে ৫ আনা সের দরে। আর চমচম বিক্রি হতো ৬ আনা থেকে ৮ আনা সের দরে। বর্তমানে পোড়াবাড়িতে ৪টি ও চারাবাড়ীতে ৫টি মিষ্টির দোকান রয়েছে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু আগে ষাটের দশকে পোড়াবাড়ির প্রসিদ্ধ চমচমের দাম ছিল সের প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা। টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িতরা এ শিল্পকে ধরে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু অতি মুনাফালোভী কতিপয় মিষ্টি ব্যবসায়ীর কারণে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম ঐতিহ্য হারিয়ে অস্তিত্ব হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁচেছে। জেলা হোটেল রেস্তোরাঁ ও মিষ্টির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও জয় কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এর স্বত্বাধিকারী স্বপন ঘোষ জানান, আমার প্রতিষ্ঠান জয় কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দীর্ঘ ৮৫ বছর ধরে মিষ্টির স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রেখে সততা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। দেশের বাইরেও চাহিদা বাড়ছে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের চমচমের।

এ বিভাগের আরো খবর