দেশের রাজনীতি-সচেতন সবার দৃষ্টি এখন রাজধানী লন্ডনে। আগামীকাল শুক্রবার যুক্তরাজ্যে সফররত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে ভোটের দিনক্ষণ, সংস্কার, জুলাই সনদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কী বোঝাপড়া হয়, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
সংস্কার, নির্বাচনসহ চলমান রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝে এমন একটি বৈঠক নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপশার মানুষের মধ্যে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক এপ্রিলে ভোটের ঘোষণাকে বিএনপি মেনে নেয়নি। ফলে ভোটের সময় নিয়ে বিতর্ক এখনো মেটেনি। তবে এই বৈঠকের খবরে এসব বিষয় নিয়ে কয়েক মাস ধরে রাজনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণায় সেটি আপাতত কমেছে।
গত সোমবার বিকালে চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। লন্ডনে যে হোটেলে প্রধান উপদেষ্টা উঠেছেন সেখানেই তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা না থাকলেও ২ ঘণ্টার গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে সব বিষয়েই তাদের মধ্যে কথা হবে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক মহল এই সাক্ষাতকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং জুলাই সনদসহ আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যে দূরত্ব বা মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কমে আসতে পারে।
ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। বিএনপিসহ অনেক দল এ ‘সময়সীমা’ মেনে না নিলেও ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে। যদিও রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, রোজার আগে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোটের সময় নির্ধারণ করতে পারলে রাজনৈতিক বোঝাপড়া আরও স্বস্তিদায়ক হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই সাক্ষাৎ যাতে হয়, এ ব্যাপারে সর্বশেষ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ভূমিকা রাখেন। পরে দুই পক্ষের ইচ্ছায়, বিশেষ করে সরকারের দিক থেকে বাড়তি আগ্রহে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ হয়। এ বিষয়ে গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। তারা এই সাক্ষাতকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য হিতকর হবে বলে মনে করেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভূমিকা রাখেন। খালেদা জিয়াকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ৭ জুন রাতে তাঁর বাসভবনে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তখন তিনি জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে জানতে চান, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে এত দূরত্ব তৈরি করা হলো কেন। তিনি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, এই সময়ে কোনো বিষয় নিয়ে রাজপথে যাওয়া ঠিক হবে না। যত সমস্যাই থাকুক, আলোচনায় বসে সমাধান করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির নেতাদের এই সাক্ষাতের পরদিন রোববার খালেদা জিয়া তার বড় ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভা হয়। এই সভা থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সৌজন্য সাক্ষাতকে স্বাগত জানানো হয়। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই সাক্ষাৎ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ প্রস্তুত করতে সহায়ক হতে পারে।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দেশের রাজনৈতিক সংকট কাটাতে বৈঠকটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এ বৈঠক অত্যন্ত বড় একটি ইভেন্ট, ‘মেজর পলিটিক্যাল ইভেন্ট’। এ সাক্ষাৎটি হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে, নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে দেশের রাজনীতিতে। এ সময় তিনি খুব শিগগিরই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
শফিকুল আলম বলেন, ‘১৩ জুন শুক্রবার লন্ডনে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকের নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা (আলোচ্যসূচি) নেই। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রফেসর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তারা যখন বসবেন, তখন বাংলাদেশের এখনকার যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচন, জুলাই চার্টার (জুলাই সনদ)—এগুলোর যেকোনো বিষয়ে আলাপ হতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনে অনুষ্ঠেয় বৈঠক প্রসঙ্গে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বুধবার বলেন, ‘গোটা জাতি আজ লন্ডনের দিকে তাকিয়ে।’
বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস করি, এটি হবে ঐতিহাসিক বৈঠক এবং এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে।’
রিজভী বলেন, ইতোমধ্যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে বিএনপি। যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন হবে বলে জাতি প্রত্যাশা করে। আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনসহ সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।