সংস্কারের নামে সংবিধানে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী নারীবাদী ও বহুত্ববাদের দর্শনকে বাংলার মানুষ গ্রহণ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে ইসলামপন্থি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
এর বদলে নারীদের অধিকার আদায় ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইসলাম সমর্থিত নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সংগঠনটি।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত মহাসমাবেশে সংগঠনটির নেতারা এসব কথা বলেন ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় বলা হয়, নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ে আগামী মাসগুলোতে হেফাজতে ইসলাম মাঠে থাকবে।
এর আগে সকাল ৯টায় হেফাজতের আমির মাওলানা শাহ্ মুহিব্বুল্লাহ্ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে মহাসমাবেশের উদ্বোধন করেন শাপলা চত্বরের শহীদ ইউনূস মোল্লার বাবা মো. নাজিম উদ্দিন।
মহাসমাবেশে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ১২ দফা ঘোষণাপত্র দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন সংগঠনটির নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক।
ঘোষণাপত্রের প্রথম দফাতে নারী সংস্কার কমিশন ও প্রতিবেদন বাতিলের পাশাপাশি আলেম ও নারী প্রতিনিধি নিয়ে নতুন কমিশন গঠনের দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন ও বহুত্ববাদ বাদ দিতে হবে। শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যনালের গতি আনতে হবে, নির্বাচনের আগে বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচার ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে। চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদের হাতে নিহত সাইফুলের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। শেখ হাসিনার আমলে দায়ের করা সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও যারা গুম-খুন করেছে তাদের বিচার করতে হবে। গাজায় হামলা নিয়ে সরকারের অবস্থান ও ভূমিকা রাখতে হবে। প্রাইমারি থেকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মানবিক করিডোরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশিদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানায় হেফাজত।
হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবু নগরীর বক্তব্য পাঠ করেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করি। আজও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মতো আবারও ইস্পাতকঠিন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছি- এনজিও গোষ্ঠীর প্ররোচনায় ইসলামবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অবিলম্বে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে ধর্মীয় অবমাননা শাস্তির আইন বাতিলের সুপারিশ বাতিল করতে হবে। ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
মহাসমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হুঁশিয়ারি দেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। তারা বলেন, হাসিনার মতো ভুল না করবেন না। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো নীতি বাস্তবায়ন করার সাহস করবেন না। অবিলম্বে প্রতিবেদনসহ নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল ঘোষণা করুন। শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করুন।
বাক-স্বাধীনতার নামে ইসলামের বিরোধিতা করলে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে মাওলানা ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করে এবং মানবিক করিডোরের নামে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, নারীবিষয়ক বিতর্কিত সংস্কার কমিশন গঠন করে আমাদের দৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিক্রির সওদাবাজি হচ্ছে কি না তাও দেখতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করতে হবে এটা আমাদের প্রথম ঘোষণা। যদি দাবি মানা না হয় তাহলে আমরা পরবর্তীতে আরও কঠিন ঘোষণা করব। আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের নামার ব্যবস্থা করবেন না। যদি জাতি নেমে যায়, হেফাজত নেমে যায় তাহলে কোনো উপদেষ্টা এদেশে থাকতে পারবে না।
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, বাংলাদেশে ইসলাম থাকলে আমরা থাকব। আল্লাহু আকবর বলে গণ-অভ্যুত্থান হওয়া নতুন বাংলাদেশে ইসলামের জন্য মাঠে নামতে হবে, এটা ভাবিনি। দেশে ইসলামবিরোধী কিছু করতে হলে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব দেশের আপামর মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। সংস্কারের নামে সংবিধানে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী নারীবাদী ও বহুত্ববাদের দর্শনকে বাংলার মানুষ গ্রহণ করবে না।
পরে নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা ও হেফাজতের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবু নগরীর মুনাজাতের মধ্য দিয়ে মহাসমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম।
নতুন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামী ৩ মাসের মধ্যে প্রত্যেক বিভাগে সম্মেলন ও ২৩ মে বাদ জুমা সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল করবে সংগঠনটি। হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন করা হবে। চার দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২৩ মে বাদ জুমা বিক্ষোভ মিছিল করা হবে।