রাতের বেলায় খাওয়ানো হয় ঘুমের ট্যাবলেট আর দিনের বেলায় শিকলবন্দী করে রাখা হয় পরিত্যক্ত ঘরে। চিকিৎসা ছাড়াই এভাবে প্রায় দেড় যুগ ধরে দুঃসহ মানবেতর জীবন যাপন করছেন বিনন্দ নামের এক যুবক।
পরিবারের অসচ্ছলতা আর অর্থিক দৈন্যতায় কোন চিকিৎসা করতে না পারা মানসিক ব্যধিতে ভোগা শিকলবন্দী ওই যুবক ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার হাসপাতাল রোডস্থ এলাকার নিমাই চন্দ্র ঋষি ওরফে ভুট্টো কর্মকারের ছেলে। সাড়ে ৩ বছর বয়সে আচমকা তার মুখে একধরণের ঘা দেখাদেয়। এরপর থেকে মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা বের হওয়া শুরু হয়। অভাব অনটনের সংসারে বিনন্দের চিকিৎসা করতে না পারায় কিছুদিন পর তার অসুস্থতা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। সেইসাথে তার আচরণও অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। বয়স বাড়ার পাশাপাশি যথেচ্ছাচারী আচরনের মাত্রাও আরও বেশি বেড়ে যায়। তার উন্মাদনা অত্যাচারের রেহাই পেতে তাকে রাতের বেলায় ঘুম পাড়াতে খাওয়ানো হয় ঘুমের বড়ি। আর দিনের বেলায় তালা লাগিয়ে শিকলে বন্দি করে রাখা হয় ।
সরেজমিনে পৌরসভার হাসপাতাল রোডে গিয়ে দেখাযায় পরিত্যক্ত ছোট্ট একটি গোয়াল ঘরে বিনন্দকে পায়ে শিকল লাগিয়ে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। ভ্যাপসা গরমে বিনন্দ ছুট ফাট ও চিল্লাচিল্লি করছেন। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। সামনে যা পাচ্ছে তাই আস্ত গিলে খাচ্ছে। তার উশৃংখলতায়ই যেনো তিনি অনেকটা পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বৈশাখি জানান, বিনন্দ তার ছোট দেবর। বিনন্দ মানসিক রোগি হওয়ায় প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিলেও সে কিছুই বলতে পারেন না। জামা কাপড়েই প্রসাব পায়খানা করে সব কিছু নষ্ট করেন। তাকে নিয়ে আমরা খুব কষ্টে আছি।
বিনন্দের চিকিৎসাবিহীন মানবেতর জীবন যাপনে ছোট বোন বিথী চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, আমি ছোট্ট বেলা থেকেই দেখতেছি আমার ভাই কে তালা দিয়ে রাখে। ওর কোন কিছুর প্রয়োজন হলেও কিছু বলতে পারে না। শিকল লাগানোর কারণে কান্না করে। এতে আমার খুব খারাপ লাগে । ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে আমার ভাই সুস্থ হয়ে উঠতো। আমাদের আর্থিক সমস্যার কারণে তার চিকিৎসা করাতে পারছে না।
মা চাম্মুনি ঋষি বলেন,হামাগুড়ি দেওয়ার বয়সেই তার অসুখ দেখা দেয়। যখন তার বয়স ৪ বছর তখন থেকেই তার আচরণ কেমন জানি অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। সারাদিন শুধু চিল্লেপালা করে। ওর জন্য আমাদের সবাইকে সব সময় সতর্কতার মধ্যেই থাকতে হয়। কষ্টের সংসারে মেয়ে বিয়ে সাদি দিয়ে এখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা হয়েছে। চিকিৎসা করাতে পারলে তো শিকলবন্দী করতাম না। সরকারিভাবে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম।
বাবা নিমাই চন্দ্র ঋষি জানান, ছোটবেলায় অসুস্থ হলে পয়সার জন্য কোন চিকিৎসা করাতে পারি নাই, মনে করলাম বড় হয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে কিন্তু বড় হলে তার সমস্যা আরও বাড়ছে। তার অত্যাচারের কারনে তাকে বাইন্দা রাখতে হয়। টাকা পয়সার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারতেছি না। সরকারিভাবে চিকিৎসার কোন সুযোগ থাকলে তা ব্যবস্থার আবেদন জানান তিনি।
স্থানীয় শামীম আহম্মেদ জানান, ছেলেটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার পর থেকেই শিকলবন্দী অবস্থায় দিনের পর দিন রাতের পর রাত কাটাচ্ছে। বছরের দুয়েক আগেও শারীরিক ভাবে ছেলেটা বেশ মোটাতাজা ও হৃষ্টপুষ্ট ছিল, এখন দিনদিন শরির শুকিয়ে আগের চেয়ে অনেকটাই ছোট হয়েগেছে। আমার ধারণা ছেলেটি যদি উন্নত চিকিৎসা পেতো তাহলে এতদিন হয়তোবা সুস্থ হয়ে উঠতো। বিনন্দের পরিবারটি খুবই দরিদ্র,সরকারি সহায়তায় তার চিকিৎসা করা হলে খুবই ভালো হতো।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার মোজাম্মেল হোসেন এর সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক বাংলা কে বলেন, তার সুচিকিৎসার জন্য উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে দেখবো, দেখি কোন কিছু করা যায় কিনা।
মো. আল- আমিন ,ময়মনসিংহ প্রতিনিধি