বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ডিলারকে মারধরের অভিযোগ

  •    
  • ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১৩:০৫

বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আবীর হোসেন অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে মোবাইল ফোনে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় এক ডিলারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কিশোরগঞ্জের উপপরিচালকের (বীজ বিপণন) বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই ডিলার। অভিযোগের একটি কপি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে।

অভিযুক্ত কর্মকর্তার নাম একেএম মনিরুজ্জামান। এ ঘটনায় তার সঙ্গে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ও গুদাম রক্ষক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুজনই বিএডিসি, কিশোরগঞ্জে কর্মরত।

মহাব্যস্থাপক (বীজ) মো. আবীর হোসেন মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

কী আছে লিখিত অভিযোগে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ডিলার জানান, গত ৪ নভেম্বর বীজ উত্তোলনের জন্য গুদামে যান তিনি। গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়ামের কাছে গেলে হাতের ইশারায় অতিরিক্ত টাকা নিয়ে উপপরিচালকের (বীজ) কাছে যেতে বলেন। সেখানে গেলে উপপরিচালক জানান, বীজের বরাদ্দের সময় শেষ। এখন বীজ নিতে হলে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা এবং মধুপুরের বীজ নিতে হলে প্রতি টনে ৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। ডিলারশিপ টিকিয়ে রাখতে ৫ টন ব্রি ধান-২৯-এর (মধুপুর বীজ ধান) কথা বলেন। তখন কর্মকর্তা হিসাব করে ১৫ হাজার টাকা দিতে বললে দর কষাকষি করে ১২ হাজার টাকা দেন তিনি। ওই সময় ৮ টন ব্রি ধান-২৯ এবং অন্যান্য জাতের ৩.৮ টন ধানের মেমো করে বাড়িতে চলে যান তিনি।

ডিলারের ভাষ্য, পরের দিন গাড়ি পাঠানোর পর মধুপরের বীজ না দিয়ে ভিন্ন বীজ দেয়া হয় তাকে। পরে ১০ নভেম্বর মধুপুরের বীজের জন্য প্রদানকৃত অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা ফেরত নিতে আসেন তিনি। সে সময় উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান তাকে গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবের কাছে যেতে বলেন। শুভ্রানিয়াম তখন পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দেন ডিলারকে। বাকি টাকা চাওয়ার পর উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান ও গুদাম রক্ষক শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব মিলে মারধর করেন তাকে। পরে ২০ নভেম্বর মহাব্যবস্থাপক (বীজ) বরাবর লি়খিত অভিযোগ করেন ওই ডিলার, তবে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা।

বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ

উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও উঠেছে। বিশেষ এ টোকেন হাতে থাকলে সিরিয়াল ছাড়া পছন্দমতো বীজ সংগ্রহ করা যায়।

এ কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত এমন একটি বিশেষ টোকেনের ছবি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। তাতে দেখা যায়, এক ডিলারকে ১০ টন ডায়মন্ড আলু বীজের একটি বিশেষ টোকেন দিয়েছেন তিনি। একসঙ্গে ১০ টন একজনকে দিলে সমালোচনায় পড়তে পারেন বলে দুইভাগে লিখে দিয়েছেন।

বিশেষ টোকেনপ্রাপ্ত ওই ডিলারের কাছ থেকেও মনিরুজ্জামান ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব টোকেনের মাধ্যমে আলু বীজের কেজিপ্রতি তিন থেকে ১০ টাকাও নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, এবার কিশোরগঞ্জে ৩৮৯ টন আলুর বরাদ্দ আসে।

কেজিপ্রতি অতিরিক্ত টাকা নিয়ে বীজ কম দেয়ার অভিযোগও রয়েছে মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার জানান, যেখানে তারাই সঠিক দামে বীজ পান না, সেখানে কৃষকরা কীভাবে পাবে।

তাদের ভাষ্য, বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার অন্তরালে এসব কর্মকর্তাই দায়ী।

‘অনিয়ম-দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড’ শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলারের অভিযোগ, টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব।

তারা জানান, এ অফিসে উপপরিচালককে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার পরও শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবকে আলাদা ম্যানেজ করতে হয়। তা না হলে সঠিক সময়ে কেউই বীজ পান না। উপপরিচালকের পর এ অফিসে সবচেয়ে প্রভাব বেশি কাটিয়ে চলেন শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব। তার হাতের ইশারা ছাড়া এক কেজি বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণবের হুমকি-ধমকি অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা শিউলী আক্তার, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নুরুল আমিন, নিরাপত্তা প্রহরী জাকির হোসেন ও খায়রুল ইসলাম সম্মিলিতভাবে বিএডিসির সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

উল্লিখিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব জানান, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিএডিসির সচিব ড. কে এম মামুন উজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

‘বিএডিসি একটি দোকান, উপপরিচালক মহাজন’

বিএডিসির সার্বিক বিষয়ে জানতে ভৈরবের এক পুরাতন ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএডিসি অফিস তো নয়, যেন একটি দোকান। আর উপপরিচালক (ডিডি) এখানকার মহাজন। মহাজনের মতোই সবকিছু পরিচালনা এবং দরকষাকষি করে বীজ বিক্রি করেন তিনি। দোকানদার যেমন ইচ্ছামতো দোকান খোলেন আবার বন্ধ করেন, বিএডিসি অফিসও বর্তমানেও তেমনই।’

তিনি আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা ছাড়া কোনো বীজ দেন না উপপরিচালক। তার আচরণে বেশির ভাগ ডিলারই ক্ষুদ্ধ। শুধু ডিলারশিপ টিকিয়ে রাখতে মুখ বুজে সহ্য করেন।’

বীজ বিপণন অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করার অভিযোগ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার অভিযোগ করেন, উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান এবং সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ও গুদাম রক্ষক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব যৌথভাবে বীজ বিপণন অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বীজ ডিলাররা বরাদ্দ অনুযায়ী বীজ বা অবীজ কোনোটাই উত্তোলন করতে পারেন না।

ডিলারদের ভাষ্য, অতিরিক্ত টাকা না পেলে দুই কর্মকর্তা বীজ বিক্রি করেন না। ঘুষ চাওয়ার প্রতিবাদ করলে ডিলারশিপ বাতিল করার হুমকি দেয়া হয়। ঘুষের টাকা ফেরত চাওয়ায় সম্প্রতি এক ডিলারকে মারধর করেছেন তিনি।

তারা জানান, অতিরিক্ত টাকা হাতে পেলে অধিক বীজের গেস্ট হাউসে বসে বিশেষ টোকেন দেন উপপরিচালক। পরে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন গুদামরক্ষক।

বিএডিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ বোরো মৌসুমে কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে মোট বরাদ্দ আসে ৩ হাজার ২০০ টন বীজ। এ মৌসুমে ১ হাজার ৪৫০ টনের মতো বীজ বিক্রি হলেও অবিক্রিত রয়ে গেছে ১ হাজার ৭৫০ টন বীজ।

চলতি বোরো মৌসুমে ১ হাজার ৭৫০ টনের বেশি বীজ অবিক্রিত থাকায় সরকারের ২ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকার লোকসান গোনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। বাধ্য হয়ে এ ধানবীজ এখন অবীজ হিসেবে বিক্রি করতে হবে। আর অবীজ (খাদ্য) হিসেবে বিক্রি করলে সরকারে প্রতি কেজিতে লোকসান হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।

ডিলারদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত পরিমাণ বীজ থাকা সত্ত্বেও প্রতি টনে তিন থেকে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত না দিলে বীজ পান না তারা। এতে মাঠ পর্যায়ে বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিএডিসির বীজের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার টন বীজ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিলার জানান, ২০২৪-২৫ মৌসুমে ভিত্তি ধানবীজের প্রতি টনে ৪ হাজার টাকা এবং মধুপুরের ধানবীজে ৩ হাজার টাকা এবং অন্যান্য যেকোনো জাতের বীজ নিতে হলে ১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে বাধ্য করেছেন উপপরিচালক একেএম মনিরুজ্জামান ও সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শুভ্রানিয়াম বৈষ্ণব। তাদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে ডিলাররা প্রয়োজনমতো ধানবীজ উত্তোলন করতে পারেন না। ফলে প্রতি বছর অনেক ধানবীজ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এই দুই কর্মকর্তা নিজেরা লাখ টাকা উপার্জন করতে গিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান করছেন।

অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এবারই প্রথম নয়

বিএডিসি কিশোরগঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে যেমন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তেমন অভিযোগ আগেও পাওয়া গেছে। অতীতেও একইভাবে অনিয়ম করেছেন উপপরিচালক। একইভাবে ২০২৩-২৪ বোরো মৌসুমে মোট বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪০০ টন। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৬০ টনের মতো বীজ বিক্রি হয়। তখনও ১ হাজার ৭০০ টন বীজ অবিক্রিত থাকায় সরকারের লোকসান হয় ২ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা।

বিএডিসি সূত্র আরও জানায়, ওই সময়ে অবিক্রিত বোরো ধানবীজ পরে অবীজ(খাদ্য) হিসেবে বিক্রিতে ডিলারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়।

ডিলাররা জানান, ১ হাজার ৭০০ টন অবীজ ধানের মধ্যে ডিলারদের জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত হিসেবে কোনো পরিমাণ ধান উত্তোলন করতে পারেননি। ব্রি ধান-২৮-এর চালের চাহিদা বেশি হওয়ায় প্রতি টনে ৪ হাজার টাকা করে ৩০০ টন ধান বিক্রি করেন। এখান থেকে অতিরিক্ত ১২ লাখ আদায় করেন উপপরিচালক। বাকি ধান প্রতি টনে এক থেকে দুই হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়ে বিক্রি করেন মনিরুজ্জামান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানায়, অবীজ বিক্রিতে মোটা অঙ্কের অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ রয়েছে এ কর্মকর্তার। তাই প্রতি বছর ইচ্ছাকৃতভাবেই বীজ অবিক্রিত রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।

অভিযুক্ত ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ভাষ্য

এ বিষয়ে বিএডিসি কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক (বীজ বিপণন) একে এম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বীজ নিয়ে অনেক ডিলারদের চাহিদা থাকে। সবসময় সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

‘তাই অনেকে বিভিন্ন অভিযোগ করতে পারে। এসব অভিযোগের সত্যতা নেই।’

বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) আবীর হোসেন অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর