দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় উপদ্রুত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি-বন্যায় বৃহস্পতিবার রাত ১০টা পর্যন্ত চার জেলায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে- বন্যার কারণে কুমিল্লায় চারজন, কক্সবাজারে দুইজন এবং ফেনীতে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন মারা গেছেন।
দেশের চলমান ভয়াবহ বন্যায় আট জেলায় ২৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর অধিকাংশ বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। নদ-নদীগুলোতে পানি বেড়ে চলেছে।
ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এই আট জেলায় মোট চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য এক হাজার ৫৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জনকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বিস্তারিত।
কুমিল্লা
চলমান বন্যায় কুমিল্লায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে দু’জন বন্যার পানিতে তলিয়ে, একজন বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং একজন মাথায় গাছ পড়ে মারা গেছেন।
মৃতরা হলেন- নাঙ্গলকোট পৌরসভার দাউদপুর এলাকার কেরামত আলী, কুমিল্লা শহরের ছোট এলাকার কিশোর রাফি ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাকাটিয়া গ্রামের কানু মিয়ার ছেলে শাহাদাত হোসেন। লাকসামে পানিতে তলিয়ে মারা যাওয়া শিশুর নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
কক্সবাজার
টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কক্সবাজারে দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার পানিতে ভেসে গিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- রামু উপজেলার সাচিং মারমা ও আমজাদ হোছন।
এদিকে ঈদগাঁও, চকরিয়া-পেকুয়া আর রামুতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন এসব উপজেলার শতাধিক গ্রামের মানুষ।
রামু উপজেলার গর্জনিয়ার ক্যাজরবিল, ডেঙ্গারচর, পশ্চিম বোমাংখিল, জুমপাড়া, পাতালবরপাড়া, রাজঘাট, জাউচপাড়া, মরিচ্যাচার, জুমছড়ি, পূর্বজুমছড়ি, মইন্যাকাটা, পূর্ববোমাংখিল, বোমাংখিল ও মাঝিরকাটার একাংশের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
রামুর বাসিন্দা রোমান বলেন, টানা বৃষ্টিতে রামুর বিভিন্ন নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢলের পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
রামু থানার ওসি আবু তাহের দেওয়ান বলেন, টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে রামুর বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢলের পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ঈঁদগাও উপজেলার ইসলামাবাদ, পোকখালী ও ইসলামপুর এলাকার মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভেসে গেছে মাছের ঘের, গবাদিপশুর খামার।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেখানে উদ্ধার কার্যক্রম ও শুকনো খাবার সরবরাহের প্রস্তুতি চলছে।
ফেনী
ফুলগাজী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে একজন মারা গেছেন। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিষয়টি জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানায়, মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যায় কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজারের এক লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৩টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৪৮ মানুষ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আখাউড়ায় পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ডুবে সুবর্ণা আক্তার নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুর ২টার দিকে উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরচন্দ্রপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সুর্বণা আক্তার ওই গ্রামের পারভেজ মিয়ার স্ত্রী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) রাত থেকে আখাউড়ায় ভারী বর্ষণ শুরু হয়। বুধবার সকাল থেকে আখাউড়া স্থলবন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল দিয়ে ভারত থেকে তীব্র বেগে পানি ঢুকতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরো স্থলবন্দর এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় বন্দরের যাত্রী পারাপার ও আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।
পাহাড়ি ঢলের পানি গ্রামেও ঢুকে পড়েছে। পানি সুবর্ণাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। সুবর্ণার ভাই তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য প্রথমে তার প্রথম সন্তানকে ঘর থেকে রাস্তায় রেখে আসতে যান। পরবর্তীতে সুবর্ণাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। তবে সুবর্ণা তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যান। পরে তার ভাই ও স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
টানা ভারী বৃষ্টি ও বাঁধ খুলে দেওয়ায় ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যার পানিতে লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর-ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। সেসব এলাকায় দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়।