সড়কের পাশে সারি সারি তালগাছ। সেই গাছের ছায়ায় পথিকের পথচলা। বাংলাদেশের গ্রামীণ সড়কগুলোতে এমন দৃশ্য অচেনা নয়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার মহোৎসবে কমছে তালগাছের সংখ্যা।
এমন বাস্তবতায় বজ্রপাতের সময় ঢাল হয়ে দাঁড়ানো তালগাছের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন নওগাঁর সংবাদিক ও সমাজকর্মী মাহমুদুন নবী বেলাল।
জেলার মান্দা উপজেলার বৈলশিং পানাতাপা গ্রামের এ বাসিন্দার ভাষ্য, নিজ উদ্যোগে গত সাত বছরে নওগাঁ ও রাজশাহী জেলায় তিন লাখ তালগাছ রোপণ করেছেন তিনি। তালগাছকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতেই তার এ উদ্যোগ।
এ সমাজকর্মী জানান, ৮০ কিলোমিটার সড়কে তালগাছের পাশাপাশি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ৩০ হাজার ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণ করেছেন তিনি।
নওগাঁর বিভিন্ন সড়ক ও নওগাঁ-রাজশাহী সড়কে প্রতিনিয়ত গাছ লাগানোর পাশাপাশি পরিচর্যায় সময় পার করেন বেলাল। তার এমন উদ্যোগ নজর কেড়েছে অনেকের।
তালগাছ রোপণের বিষয়ে বেলাল বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গত সাত বছর ধরে জেলার বিভিন্ন স্থানে ও রাস্তার পাশে তিন লাখ তালবীজ রোপণ করেছি। পাশাপাশি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওহাটা মোড় থেকে রানীরপুকুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী ৩০ হাজার গাছের চারা রোপণ করেছি।
‘এ ছাড়া নওগাঁ আদালত চত্বরের সামনেও বিভিন্ন প্রজাতির দুই শতাধিক গাছের চারা রোপণ করে নিজেই নিয়মিত পরিচর্যা করছি।’
তিনি বলেন, ‘গত সাত বছর নওগাঁ ও রাজশাহীর সড়কের দুই পাশে প্রায় তিন লাখ করে তালবীজ রোপণ করেছি। এ কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তালবীজ রোপণে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এমন উদ্যোগ আগামীতে চালিয়ে যেতে পারব।’
তালের আঁটি রোপণে বেলালকে সাহস দিয়েছেন তার বাবা স্বাস্থ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিম হোসেন ও বেলালের স্ত্রী মৌসুমী খাতুন।
এক যুগ আগে গহের আলী নামের এক ব্যক্তি তালগাছ রোপণ করে পেয়েছিলেন জাতীয় পরিবেশ পদক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে ২০০৯ সালে পদক তুলে দিয়েছিলেন। এর পরের বছর মারা যান গহের আলী।
সেই ফলবতী তালগাছগুলো এখন আর নেই। সড়ক প্রশস্ত করতে গিয়ে সব গাছ কাটা পড়েছে।
গহের আলীর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মাহমুদুন নবী বেলাল। নতুন করে রোপণ করেছেন তালের আঁটি। একদিন গহের আলীর সেই স্থানে তালগাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস তার।
বেলাল বলেন, ‘আমার ইচ্ছা এই বর্ষায় নওগাঁ সদর উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিনা মূল্যে রোপণের জন্য বিতরণ করব। এ লক্ষ্যে প্রায় ৩০ হাজার গাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে।’
সরকারিভাবে বেশি বেশি গাছের চারা বিতরণের উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানান এ বৃক্ষপ্রেমী।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে তালগাছ রোপণের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মাহমুদুন নবী বেলাল সত্যিই সুন্দর একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। যত বেশি গাছ লাগানো হবে, তত বেশি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে।
‘দেশের প্রায় সর্বত্রই তাল গাছসহ বড় বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এতে করে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। তার এমন মহতী উদ্যোগ সকলের জন্য অনুকরণীয় হবে বলে বিশ্বাস করি।’
জেলা বন অফিস নওগাঁর সহকারী বন সংরক্ষক মেহেদীজ্জামান বলেন, ‘যেভাবে তালগাছ কাটা হচ্ছে সেভাবে তালগাছ রোপণ করা হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনবসতি বাড়ায় গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছপালাসহ জঙ্গল কেটে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে তালগাছসহ অনেক জাতের গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
‘মাহমুদুন নবী বেলালের এমন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তার কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে আমরা তার পাশে থাকব।’