নওগাঁয় এক প্রসূতিকে সিজারের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও পেটে গজ রেখেই সেলাই করে দেয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে দুবার আইসিইউতে নীবিড় পর্যক্ষেণে থাকার পর মৃত্যু হয়েছে তার।
মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় সুমি খাতুন নামের ওই নারীর।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ডাক্তার ও ক্লিনিক মালিকের বিচার দাবি করেছেন সুমির প্রতিবেশী ও স্বজনরা।
এ বিষয়ে গত ২০ মে নিউজবাংলায় ‘পেটে গজ রেখেই সেলাই, গুরুতর অসুস্থ প্রসূতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে টনক নড়ে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের। তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখনও প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। এর মাঝেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন সুমি।
সুমির পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ মে প্রসবব্যথা শুরু হলে শহরের হাসপাতাল রোড এলাকায় অবস্থিত একতা ক্লিনিকে নেয়া হয় ওই প্রসূতি নারীকে। সেখানে ওই দিনই সিজার করান প্রসূতি বিদ্যা ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ সার্জন ডাক্তার তানিয়া রহমান তনি।
সিজারের জন্য জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করেন ডাক্তার তানিয়ার স্বামী নওগাঁ সদর হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডাক্তার আদনান ফারুক।
পরিবার জানায়, সিজারের পরই ওই সুমি তার পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন এবং প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ডাক্তার তানিয়া ক্লিনিকের মার্কেটিং অফিসার আব্দুর রউফকে দিয়ে দ্রুত রোগীর পেটে সেলাই করিয়ে নেয়। তার পর বুধবার রাত ১০টার দিকে রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয় সুমিকে।
রামেক সূত্র জানায়, হাসপাতালে নেয়ার পর রাতেই আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে জানা যায় সুমির পেটে বাড়তি কিছু একটা জিনিস রয়েছে। আর সেটার জন্য তাকে বৃহস্পতিবার সকালে পরিবারের সম্মতিতে ফের অপারেশন করার পর পেট থেকে গজ পাওয়া যায়।
এর ১৩দিন পর মঙ্গলবার সকালে মারা যায় সুমি। সুমির এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার প্রতিবেশিরারও।
প্রতিবেশী ফারজানা খাতুন ও খালেদ বিন ফিরোজ বলেন, পেটে ব্যাথা উঠল, ভর্তি করা হলো সিজারের জন্য। আস্থা ও ভরসা নিয়েই তো ক্লিনিকে ডাক্তারের কাছে যায় রোগী, কিন্তু একটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল। সিজার করার কারণে কীভাবে প্রসূতি মারা যায়? অবশ্যই ভুল অপারেশন বা ভুল চিকিৎসা হয়েছে। নইলে কেন উন্নত চিকিৎসার জন্য নওগাঁ থেকে রাজশাহীতে রেফার করা হলো? আর কত মানুষ অপচিকিৎসার কারণে মারা যাবে?
তারা বলেন, মাঝে মাঝেই শুনতে পাই, নওগাঁয় ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এসব ডাক্তার ও ক্লিনিক মালিকদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
সুমি খাতুনের খালা ফাহিমা বেগম বলেন, ‘আমার ভাগ্নীকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। তার তিনটি বাচ্চার এখন কী হবে? সদ্যজাত সন্তান তো পৃথিবীর আলো দেখার পরই মাকে হারিয়ে ফেলল। ভুল সিজারিয়ানের কারণেই সুমির মৃত্যু হয়েছে। জড়িত সবার কঠিন শাস্তি চাই আমরা।’
সুমির খাতুনের মা রহিমা বেগম বলেন, ‘অভিযুক্তরা লোকজনের মাধ্যমে টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। আমরা তাতে রাজি হইনি।
‘রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা যখন প্রথমে সুমিকে দেখেছিল, তখনই বলেছিল- এই রোগীর অবস্থা খুব খারাপ, নওগাঁতে প্রোপারভাবে (ঠিকঠাক) সিজারিয়ান করা হয়নি। তারপর যখন সেখানে অপারেশন করল তখন ডাক্তাররা জানায়, সুমির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও পেটে সামান্য গজ ছিল। যে কারণে শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘দুইবার আইসিইউতে নেয়ার পরও আমার মেয়েটাকে বাঁচানো গেল না। আমার মেয়েটাকে নওগাঁর একতা ক্লিনিকে গরুকে সেলাই করার মতো হাঁটুর ওপর উঠে সেলাই করেছিল। সবকিছুই তাদের ভুল চিকিৎসা ছিল। ওই ডাক্তার তানিয়াকে কাছে পেলে তার হাটুর ওপর উঠে ওভাবেই সেলাই করে দিতাম।
‘অভিযুক্ত ডাক্তার, ক্লিনিক মালিক ও এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার দাবি করছি। আর যেন আমার সুমির মতো কারও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু না হয়।’
অভিযুক্ত ডা. তানিয়া রহমান তনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইনা। প্রয়োজনে ডাক্তারদের সংগঠন বা সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমার যা বলার, তা কিছুদিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছি। আর রাজশাহীতে সুমিকে নিয়ে যাওয়ার পর কী হয়েছে সে বিষয়ে আমি অবগত নই।’
এ বিষয়ে কথা হলে সিভিল সার্জন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। রামেক হাসপাতালের পরিচালককে বিষয়টি নিয়ে চিঠিও দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’