ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে খুনের ঘটনায় জিহাদ হাওলাদার নামে ২৪ বছর বয়সী এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি। পরে তাকে ১২ দিনের রিমান্ড দিয়েছে দেশটির বারাসাতের আদালত।
কলকাতা পুলিশের ভাষ্য, এমপি আনারকে হত্যার পর তার শরীর থেকে মাংস ও হাড় আলাদা করে ফেলেন জিহাদ। পরিচয় নষ্ট করার জন্য এমপির মাংস কিমা করে তা প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখেন। আর হাড়গুলো টুকরো টুকরো করেন। পরে ওই ব্যাগগুলো ফ্ল্যাট থেকে বের করে নানা ধরনের পরিবহন ব্যবহার করে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ফেলে দেয়া হয়।
দুর্ধর্ষ এই যুবকের বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়েনের পূর্ব বারাকপুরে। বাড়িতে তার স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দেড় বছর ধরে জিহাদ ভারতে রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা জানেন, সেখানে তিনি রং মিস্ত্রির কাজ করে।
জিহাদের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি তাকে একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।
২০২৩ সালের ২৪ মার্চ খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) খানজাহান আলী থানার শিরোমনি লিন্ডা ক্লিনিকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় শেখ আনসার আলীকে। দিঘলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
ঘটনার পরের দিন নিহতের ছেলে শেখ তানভীর বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন, যাতে ১৬ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। তবে চলতি বছরের মার্চ মাসে ওই মামলাটির চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে থানা পুলিশ।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা (বর্তমানে কেএমপির লবনচরা থানার তদন্ত পরিদর্শক) পলাশ কুমার দাস বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে মূলত তিনজন অংশ নিয়েছিল। তারা হলো- জিহাদ, রফিক ও বিল্লাল। তারা মোটরসাইকেলে করে এসে ওই নেতাকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।’
জিহাদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলার এজাহারে এই ব্যক্তির নাম ছিল না। তবে তদন্তে পাওয়া যায়, তিনি কিলিং মিশনের অন্যতম ব্যক্তি। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন।’
বারাকপুরের ভয়ংকর গ্রাম্য রাজনীতি
এলাকাবাসী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে শেখ আনসার উদ্দিনকে হত্যার ঘটনায় রাজনীতি ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে।
নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, দিঘলিয়া উপজেলার লাখোহাটির প্রভাবশালী ‘চারবাড়ি’ পরিবারের সন্তান অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনসার উদ্দিন। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বারাকপুর গ্রামে বসবাস করছিলেন।
চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এলাকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি; বারাকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদও পান। এরপর প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা গাজী জাকির হোসেনের পরিবারের সঙ্গে। বাজার কমিটির নির্বাচন, ইউপি নির্বাচনসহ সব বিষয়ে দ্বন্দ্বেই উঠে আসে তার নাম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের শুরুর দিকে বারাকপুর বাজার কমিটির নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ আনসার। ওই বছরই করোনাকালে চাল দেয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনকে লাঞ্ছিত করে তার লোকজন। এতে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ গিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
একই বছর চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে স্থানীয় নারীরা মানববন্ধন করেন। এসবের পেছনে আনসার উদ্দিনের হাত আছে বলে অভিযোগ গাজী জাকিরের স্বজনদের।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বারাকপুর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শেখ আনসার উদ্দিন। সেবার অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গাজী জাকিরের কাছে পরাজিত হন।
ভোটের আগে নির্বাচনি প্রচারকালে দুপক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় সংঘর্ষ বাঁধে। ভোটের দিন দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন।
এরপর ২০২২ সালে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন। জাকির হত্যায় আনসার উদ্দিন সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ তুলে তাকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি করা হয়। পরবর্তীতে ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন অনুসারীরা শেখ আনসার উদ্দিনকে হত্যা করেন বলে জানা যায়।
স্থানিয়রা জানান, চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের বাড়ির উত্তর পাশেই জিহাদ হাওলাদারের বাড়ি, যিনি সরাসরি গাজী জাকিরের দলের হয়ে কাজ করতেন।