ব্রিটিশ আমালের জমিদারদের সকালে নাস্তা হিসেবে থাকতো সলপের ঘোল। তৎকালীয় জমিদাররা ঘোষদের দিয়ে তৈরি করতেন এ ঘোল। বাংলাদেশ ও কলকাতার ট্রেন যাত্রীরা সলপ স্টেশনে ট্রেন থামলেই কিনতেন এ ঘোল আর মুড়কি। ঘোলের ঘনত্ব বেশি থাকায় কেউ কেউ নিতেন গামছায় মুড়িয়ে। এমনটাই শোনা যায় স্থানীয় লোকমুখে।
আর সেই থেকে এখনও জনপ্রিয় এ সলপের ঘোল।
সূর্য উঠার আগেই স্থানীয় খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় দুধ। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দিয়ে জমিয়ে রাখা হয় সারা রাত। পরের দিন বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় সুস্বাদু একটি পানীয়। সিরাজগঞ্জের সলপ রেলওয়ে স্টেশনে তৈরি সুস্বাদু এ পানীয় খ্যাতি পেয়েছে ‘সলপের ঘোল’ হিসেবে।
উল্লাপাড়া উপজেলার সলপের সুস্বাদু পানীয় হিসেবে বাঙালিদের কাছে ঘোল ও মাঠার এখনও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, তবে রমজান এলে চাহিদা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পাশাপাশি দামও বাড়ে বেশ।
স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, শতবর্ষী এ ব্যবসার শুরু ১৯২০ সালে। ব্রিটিশ শাসনামলে উল্লাপাড়ার সলপ এলাকায় রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর দুই বছর পরে ১৯২২ সালে এ স্টেশনের পাশেই ঘোল ও দধির ব্যবসা শুরু করেন স্থানীয় সাদেক আলী খান। তার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেছেন দুই ছেলে আব্দুল খালেক খান ও আব্দুল মালেক খান।
সেই থেকে এখানকার তৈরি সুস্বাদু পানীয় শুধু চলনবিল ও যমুনা নদীবেষ্টিত এ জনপদে নয়, দূরদূরান্তে ছড়িয়ে আছে সলপের ঘোলের সুনাম।
রোজার প্রথম দিন থেকেই গ্রাম কিংবা শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত ও প্রসিদ্ধ দই-মিষ্টির দোকানগুলোতে প্লাস্টিকের বোতল ও হাঁড়িতে ঘোল সাজিয়ে বিক্রি করছেন ছোট-বড় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
সলপ এলাকায় শনিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের পাশে ঘোলের দোকানগুলোতে কেনা-বেচা জমে উঠেছে। দোকানের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র সাজিয়ে চলছে বিক্রি। দোকানের পেছনে শ্রমিকরা ঘোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে এই ঘোলের জন্য এখানে এসেছেন।
ঘোল তৈরির কারিগররা বলেন, প্রতিদিন সূর্য উঠার আগেই গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা জ্বাল দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেয়ার পর পাত্রে রেখে সারা রাত রাখা হয় সেই দুধ। সকালে জমে থাকা সেই দুধের সঙ্গে চিনি ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় এ সুস্বাদু পানীয়।
ঘোল বিক্রেতারা বলেন, প্রতিদিন সলপ এলাকায় ১৭০ থেকে ২০০ মণ ঘোল ও মাঠা বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার ঘোল ৬০ টাকা ও মাঠা ৮০ টাকায় পাইকারি বিক্রি হচ্ছে, তবে জেলা শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি লিটার ঘোল ১০০ টাকা, মাঠা ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঘোল তৈরির উপকরণ দুধ ও চিনির দাম বাড়ার কারণে এই ঘোলের দাম গতবারের চেয়ে এবার বেড়েছে।
সলপ ঘোল ঘর অ্যান্ড সাদেক খান দই ঘরের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক খান জানান, তাদের এই ব্যবসার সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে গেছে। এখান থেকে কাজ শিখে কারিগররা উপজেলাতেই নিজেরাও দোকান তৈরি করেছেন। স্বাদ ও মান অনুযায়ী এই ঘোলের দাম তুলনামূলক সস্তা বলে মনে করেন ক্রেতারা। তাই সুস্বাদু এই পানীয় কিনতে তারা এখানেই আসেন।
বিক্রেতারা বলেন, গাজীপুরে সলপের ঐতিহ্যবাহী ঘোলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। অল্প দামে ভালো মানের ঘোল ও মাঠা পেয়ে গ্রাহকরাও খুশি। বিশেষ করে রমজানে চাহিদা আরও বেড়েছে। অনেক গ্রাহক আগাম অর্ডারও করছেন, তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘোল সংরক্ষণ করতে না পারায় অনেক সময় ক্রেতার চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়ে ওঠে না বলেও জানান বিক্রেতারা।
জেলার কামারখন্দ থেকে সলপের ঘোল কিনতে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘সলপ থেকে সরাসরি এই ঘোল কিনলে কম দামে পাওয়া যায়। তাই মোটরসাইকেল নিয়ে সলপের ঘোল কিনতে আমি এখানেই চলে এসেছি। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ লিটার ঘোল কিনে নিয়ে যায়।’
বেলকুচির উপজেলা থেকে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে প্রতি বছরই তিনি পাঁচ থেকে ছয় বার সলপ স্টেশনে ঘোল কিনতে আসেন।
স্থানীয় আনছার আলী, আমজাত শেখ ও আব্দুল কাদের জানান, একসময় সলপের তৈরি ঘোল ভারতের কলকাতার মানুষের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। ট্রেনে করে প্রতিদিন ঘোল চলে যেত কলকাতায়।
চৌবাড়ী সালমা জাহান ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ সরকার বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে ট্রেনে চলাচল করা যাত্রীরা সলপের ঘোল আর মুড়কি খায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই সময় যখন ট্রেন থামতো এ স্টেশনে, তখন সকল যাত্রীরা মাটির সানকি, পদ্ম পাতা, কলার পাতায় করে এ ঘোল আর মুড়কি খেতো। সেই সময় পলিথিনের প্রচলন না থাকায় অনেকে গামছায় করে ঘোল নিয়ে যেত।’
কথা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান তৈহিদুল ইসলামের সঙ্গে।
তিনি জানান, সলপের ঘোলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে বৈশাখ মাসে এখানে ঘোলের মেলার আয়োজন করা হয়। সলপের ঘোলের স্বাদ সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ঘোল ব্যবসায়ীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার দাবিও জানান এ জনপ্রতিনিধি।
সলপের ঘোলের বিষয়ে সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রাম পদ রায় বলেন, ঘোল বা মাঠা অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি পানীয়। এ পানিতে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন, উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা শরীরের জন্য ভালো। এ কারণে যুগ যুগ ধরে মানুষ এ পানীয় পান করে আসছেন।