নানামুখী শঙ্কা কাটিয়ে রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ এই নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়েছে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, ১৪ দলীয় জোটের শরিক এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণে হচ্ছে এই নির্বাচন।
কিছু জায়গায় যেমন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, তেমনই কিছু আসনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে নিরুত্তাপ। সার্বিক বিষয় ছাপিয়ে যে বিষয়টি ঘুরে ঘুরে আলোচনায় আসছে তা হলো- কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি, ভোট প্রদানের হার।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রথম থেকেই বিষয়টি আমলে নিয়ে কাজ করছে। দল মনোনীত প্রার্থীদের পাশাপাশি দলীয় যেসব নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাদেরও স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সুযোগ উম্মুক্ত রেখেছে। তারপরও ভোট প্রদানের হার নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধি, ইইউসহ অনেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এবং শাসক দল আওয়ামী লীগ ভোট প্রদানের হার বাড়াতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুধু ভোট প্রদানের হারের ওপর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে না। পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা, ভোটার উপস্থিতি, নিরপেক্ষতা সব মিলিয়েই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।
‘তবে হ্যাঁ, ভোটার উপস্থিতি একটি বড় উপাদান। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মানুষ আগামীকালের (রোববার) নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এটা জনগণের নাগরিক দায়িত্ব। আশা করি, অতীতের জাতীয় নির্বাচনগুলোর মতোই এ নির্বাচনেও ভোট পড়বে।’
সাধারণভাবে ধরা হয় জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৪৫ শতাংশ হলে তা সন্তোষজনক। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৪০ ভাগের বেশি ভোট পড়ে। এবারও বিএনপি ও তাদের মিত্ররা ভোটে নেই। নিবন্ধন না থাকায় অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। অবশ্য দলটি বিএনপির সঙ্গে একযোগে ভোট বর্জনের দাবিতে মাঠে রয়েছে।
তারপরও আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে এবং সন্তোষজনক ভোট পড়বে। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত দলটির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু আসনে কম ভোট পড়বে- এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই তারা নির্বাচনে নেমেছেন। কিন্তু অনেক আসনে আওয়ামী লীগ-স্বতন্ত্র আবার অনেক আসনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি প্রতিযোগিতা হবে। স্বাভাবিকভাবেই সেসব আসনে ভোট বেশি পড়বে যা কম ভোট পড়া আসনগুলোর শূন্যতা অনেকাংশে পূরণ করবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দল হিসেবে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায়। অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে তারা উল্লেখযোগ্য ভোট পেলেও এখন প্রেক্ষিত ভিন্ন। তারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা ছিলো না।
‘গত ১৫ বছর বিএনপির রাজনীতি গণমাধ্যমনির্ভর। তাছাড়া এই দলের হাত ধরে দেশের কোনো অর্জন নেই। কোনো ক্রান্তিকালেও বিএনপির ভূমিকা ছিলো না। যে কারণে বিএনপির ভোট না দেয়ার আহ্বানে জনগণ সাড়া দেবে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, অনেক নেতাকে ভাবতে হচ্ছে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে। এবার ২৬৩ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী রয়েছেন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ নেতা রয়েছেন, যাদের অন্তত ১৬ জন হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখে পড়েছেন।
চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন প্রায় সমসংখ্যক মন্ত্রীও। সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জন মনোনীত নৌকার প্রার্থী হারতে পারেন স্বতন্ত্রদের কাছে। নরসিংদী-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু আহমেদ তাদের একজন। সিলেট-৬ আসনে নুরুল ইসলাম নাহিদকে লড়তে হচ্ছে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহও স্বতন্ত্র প্রার্থীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে।
গোপালগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার মাঝি লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান। এই আসনে মুকসুদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কাবির মিয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তার পক্ষে আছেন জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই।
চাঁদপুর-২ আসনে নৌকার মাঝি আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী দলের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য এম ইসফাক আহসানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। মায়া চৌধুরীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমর্থন নিয়ে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
ফরিদপুর-১ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে পারেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ্ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনিও এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমি। তাকে লড়তে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী শিল্পপতি আলম আহমেদের সঙ্গে।
উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য ঢাকা-১ (দোহার ও নবাবগঞ্জ) আসনে ভোটযুদ্ধে নৌকার মাঝি সালমান ফজলুর রহমানকে লড়তে হচ্ছে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলামের সঙ্গে।
চাঁদপুর-৩ আসনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
মৌলভীবাজার-২ আসনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। এখানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তিনি।
মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। ঈগল প্রতীক নিয়ে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম।
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস নৌকার প্রার্থী হয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে। তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব।
নেত্রকোণা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু ও মঞ্জুর কাদের কোরাইশী।
ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সানজিদা খানমকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী ড. আওলাদ হোসেন।
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া।
নরসিংদী-৪ আসনে এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন মনোহরদী উপজেলার পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু।
নওগাঁ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খালেকুজ্জামান তোতা। তিনি চন্দননগর ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-
লালমনিরহাট-২ আসনে নির্বাচন করছেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আদিতমারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হক।
গাজীপুরের সব আসেনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও তাদের মধ্যে বেশি পরিচিত মুখ গাজীপুর-৫ এর আকতারুজ্জামান। তবে স্বতন্ত্র অন্যদের পেছনে আছেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর-১ আসনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক নৌকার প্রার্থী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল।
গাজীপুর-২ আসনে নৌকার মাঝি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি কাজী আলিম উদ্দিন।
ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং ওরফে মুরাদ ও আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। দুজনই শক্তিশালী প্রার্থী।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক যুবলীগ নেতা ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
মেহেরপুর-১ আসনে আবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন দুবারের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ময়দান হয়ে ওঠায় এসব আসনের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি অনেকটাই বেশি হবে- এমনটা ধারণা করা হচ্ছে।