‘স্যার টাকা ছাড়া বই দিবে না। তাই কান্না করতে করতে বাড়ি এসে মাকে বলেছি, স্যার বই দেইনি মা। স্যার টাকা দিয়ে যেতে বলেছে।’
এভাবে অভিযোগ জানাচ্ছিল নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার রাইগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রাজিফা আকতার।
এ ছাত্রীসহ একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের অভিযোগ, স্কুল থেকে নতুন বই পেতে স্লিপ দিয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা নেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ টাকা নেয়া হয়েছে ভর্তি ও পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ। সেই স্লিপ দেখিয়ে বই সংগ্রহের পর আবারও নিয়ে নেয়া হয়েছে স্লিপ।
অভিযোগের ভিত্তিতে বিদ্যালয় গিয়ে দেখা যায়, বিষয়টি জানার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্থানীয়রা। তারা প্রধান শিক্ষকের শাস্তি দাবি করেন।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ভাষ্য
বই না পাওয়া স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রাজিফা আকতারের মা শাহিদা বেগম বলেন, ‘বছরের প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে আমার মেয়ে টাকা না দিতে পারায় বছরের প্রথম দিন বই না পেয়ে কান্না করতে করতে বাড়িতে আসলে পরে তাকে টাকা দিয়ে বই নিয়ে দেয়ার কথা বলি। আমি একজন অসহায় মানুষ। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই।
‘সেই সময় আমার কাছে টাকা না থাকায় মেয়েকে বই দেয়া হয়নি। স্কুলে যাওয়ার পর প্রধান শিক্ষককে বলি টাকা নেই, বই দেন আমার মেয়েকে। তবুও তিনি বই দেয়নি। এটা কি ঠিক করেছেন প্রধান শিক্ষক? শিক্ষকদের এমন মন-মানসিকতা থাকা কি ঠিক?’
একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আসিফ হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিন টাকা নিয়ে না আসায় বই দেয়া হয়নি। তাই আবার বাড়ি গিয়ে ৮০০ টাকা নিয়ে এসেছি নতুন বই নিতে।’
একই অভিযোগ মেহেদী হাসান ও মো. বাধন নামের আরও দুই শিক্ষার্থীর। তাদের একজন বলে, ‘প্রথম দিন বই নিতে এলে স্যার জিজ্ঞাসা করে টাকা নিয়ে আসছি কি না। পরে টাকা নিয়ে আসার কথা বললে একটা স্লিপ দেয়। সেই স্লিপ দিয়ে বই সংগ্রহ করি। পরে সেই স্লিপ ফেরত নেয়া হয়।’
হামিদুল হক নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘প্রথম দিন সন্তানের জন্য বই নিতে এসে দেখি ৮০০ টাকা ছাড়া বই দেয়া হচ্ছে না। তখন আমি তাদের বলি, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রথম দিনে টাকা ছাড়াই বই দেয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু টাকার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক কী?
‘তখন তারা সেশন ফির জন্য টাকা নেয়ার কথা জানান। নতুন বই নিয়ে নিয়ে ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করতে করতে বাড়ি যাবে, কিন্তু এখানে তার উল্টো হয়েছে। শিক্ষকদের কাছে থেকে এমনটা আশা করা যায় না।’
আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রথম দিন বই নিতে আসলে টাকার জন্য তাকে বই দেয়া হয়নি। পরে বাড়িতে গিয়ে কান্না করতে করতে বলে টাকার জন্য বই দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘টাকার জন্য বই দেয়া হয়নি। এইটা ঠিক না। কারণ প্রথম দিনে বই পেলে সন্তানদের পড়াশোনার ওপর আগ্রহ থাকে, কিন্তু বই না পেয়ে তাদের আগ্রহ কমে যাবে।’
যা বলছেন স্কুল সংশ্লিষ্টরা
উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম শাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি অসিত চন্দ বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে বই দেয়ার নিয়ম নাই। এটা ঠিক নয়। বিনা মূল্যে বই বিতরণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে।’
টাকা দিয়ে বই দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়গুলো খোঁজ নিয়ে দেখব। আর যারা বই পায়নি, তাদের কাছে বই পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহণ করব।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘সবাইকে বিনা মূল্যে বই দিতে হবে, এমন নির্দেশনা দিয়েছেন সরকার। কোনো শিক্ষক টাকার জন্য শিক্ষার্থীকে নতুন বই না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
‘আপনি যেহেতু বলেছেন যে টাকার বিনিময়ে বই দেয়া হয়েছে, এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীকে বই দেয়া হয়নি। আমি সার্বিক বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’