চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটি আসনের পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিনিয়তই হামলা, সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণসহ নানা অঘটন ঘটছে। আসনগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) এবং চট্টগ্রাম-১৪ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া)। এ দুই আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দফায়-দফায় সংঘর্ষ-ভাঙচুরের ঘটনায় নির্বাচনি পরিবেশ সহিংস হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম-১৫
বুধবার রাতে চট্টগ্রাম-১৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মোতালেবের সমর্থক এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিদোয়ানুল ইসলাম সুমনের বাড়ি ইছামতি আলীনগরে এ হামলার ঘটনা ঘটে।
এ সময় দুর্বৃত্তরা স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের প্রচারকাজে নিয়োজিত একটি ভক্সি মাইক্রোবাস, একটি ড্যাম্পার পিকআপ, পুলিশ পরিবহনে নিয়োজিত একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ ২টি অটোরিকশা ও নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুর করে।
ইউপি চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ‘আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর সমর্থকদের নেতৃত্ব গুলিবর্ষণ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সে সময় ঘটনাস্থলে পুলিশের একটি টহল দল উপস্থিত ছিল। তাদের অটোরিকশাটিকেও ছাড় দেয়নি দুর্বৃত্তরা।
ওই ঘটনার পরের দিন (বৃহস্পতিবার) নৌকার প্রার্থী নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্বাচনি প্রচার চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নদভীর শ্যালক চরতি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রুহুল্লাহ চৌধুরীসহ তার অন্তত ১৫ জন কর্মী-সমর্থক আহত হন।
বৃহস্পতিবার রাতে চরতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাটাখালী ব্রিজ এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনার পর নদভীর অভিযোগ, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের নির্দেশে এবং সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে আমার নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।’
ঘটনার পর সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস, সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শিবলী নোমান ও থানার ওসি প্রিটন সরকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
রিদুয়ানুল ইসলাম সুমন ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে নিউজবাংলাকে নদভী বলেন, ‘তিনি একজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। আমার ওপরও তিনি একাধিকবার হামলার চেষ্টা করেছেন। বুধবারের গুলি ও ভাঙচুরের ঘটনাটি রিদুয়ানের সাজানো নাটক।’
অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের দাবি, ‘ভোটারদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আবু রেজা নদভীর এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করব, নদভী ও তার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শিবলী নোমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করেছি। এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ ও স্থানীয় কিছু মানুষের মোবাইলের কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যদিও এখনও কেউ কোনো ধরনের অভিযোগ করেনি।’
তবে ঘটনার সময় পুলিশের টহল দলের উপস্থিতি এবং তাদের নীরব ভূমিকা পালনের অভিযোগের ব্যাপারটি কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
চট্টগ্রাম-১২
এদিকে, গত কয়েকদিন ধরে পটিয়া অঞ্চলের পরিস্থিতিও উত্তপ্ত রয়েছে। প্রতিনিয়তই হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে।
বুধবার কাশিয়াইসে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছনহরা ইউনিয়নে ফের হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন দুই প্রার্থী।
ছনহরা ইউনিয়নের আলমদর পাড়া এলাকায় বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নির্বাচনি ক্যাম্প ও প্রচারের মাইক ভাঙচুর এবং চালককে মারধরের অভিযোগ ওঠে।
উপজেলার কোলাগাঁওয়ের নলন্দায় স্বতন্ত্র ‘ঈগল’ প্রতীকের প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী গণসংযোগকালে নৌকার সমর্থকরা প্রচারণায় বিঘ্ন ঘটিয়ে উস্কানিমূলক স্লোগান দেয় বলে সাংবাদিকদের জানান স্বতন্ত্র প্রার্থী হুইপ সামশুল হকের নির্বাচন সমন্বয়কারী নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, পটিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নৌকার কর্মী-সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্যাম্প ও গাড়ি ভাঙচুর অব্যাহত রেখেছে। আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ঘোষণাকে পটিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করছেন নৌকার প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা।’
তিনি বলেন, ‘সড়কের পাশে রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে টাঙানো আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এ সময় ক্যাম্পের পাশে ঈগল সমর্থক আবছার উদ্দিনের বাড়িতে বাইরে থেকে টিনের বেড়া ও দরজায় রামদা ও লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।’
তবে এ বিষয়টিকে বরাবরের মতই অস্বীকার করে নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। নৌকার কেউ এ ধরনের কাজে জড়িত নয়।’
অথচ, নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর পক্ষের লোকজনই ওই ভাঙচুর চালান বলে অভিযোগ করেন ছনহরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও ঈগলের সমর্থক ওসমান আলমদার।
এ বিষয়ে এলাকার লোকজনের দাবি, ‘আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর গাড়িবহর যাওয়ার আগে আগে ৭০-৮০ নৌকার সমর্থকরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’
ঈগলের সমর্থক ২৬ বছর বয়সী রিয়াদ বলেন, ‘ক্যাম্পের পাশের দোকানে আমি বাজার করতে আসলে কয়েকজন লোক আমাকে মারধর করে।’
এ বিষয়ে পটিয়া থানার ওসি (তদন্ত) সোলাইমান বলেন, ‘কোলাগাঁওয়ে নৌকা পক্ষে মিছিল করেছে শুনেছি। ওখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হকেরও গণসংযোগ চলছিল। তাই আমরা কালারপোল পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের এলাকার আশপাশে থাকতে বলেছি। তবে ছনহরায় ক্যাম্প ভাঙচুর ও হামলার বিষয়ে এখনও মৌখিক বা লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি।’
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ আজাদীকে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিটি সংসদীয় আসনভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া আছে। তবে পটিয়া, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এবং বাঁশখালীর দিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি রাখছি। এর মধ্যে এই তিনটি আসনে কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে মামলা হয়েছে। আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
‘পটিয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। সাতকানিয়ার ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। আসামিও গ্রেপ্তার করেছি। বাঁশখালীর ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ কাউকে নষ্ট করতে দেয়া হবে না। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্টকারীদের ছাড় দেয়া হবে না।’
‘প্রার্থীরা নির্বাচনি সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় না রাখলে ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ ভোটারের এত বিশাল নির্বাচনি এলাকায় শুধু আমরা পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভাব নয়’ উল্লেখ করে এসপি এস এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের একটি থানায় ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাদেরকে থানার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতে হয়, নিয়মিত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাতে হয়, আবার নির্বাচনি এলাকার পরিবেশও ঠিক রাখার জন্যও কাজ করতে হচ্ছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে প্র্রার্থীদের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। তাদেরকে অবশ্যই আচরণবিধি মেনে চলতে হবে।’
এদিকে, আগামী ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম। পরদিন ২৬ ডিসেম্বর সকালে এলজিইডি মিলনায়তনে চট্টগ্রামের-১৬ আসনের ১২২ প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন সিইসি। এরপর দুপুর ১২টায় পিটিআই মিলনায়তনে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা আঞ্চলের সকল জেলার প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করার কথা রয়েছে তার।