দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রামে প্রচারের শুরুতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনি প্রচার শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি মেলার পর থেকে তিন দিনে জেলার একাধিক স্থানে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মাঝে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে এ দুই প্রতীকের প্রার্থী ছাড়াও অন্যান্য প্রতীকের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ৮টিতে আওয়ামী লীগের নৌকার বিরুদ্ধে ‘স্বতন্ত্র’ লড়াইয়ে নেমেছেন দলটির ৯ নেতা। এর মধ্যে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্যও। এসব আসনেই মূলত উত্তেজনা ছড়াচ্ছে।
স্বতন্ত্র ৯ আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে রয়েছেন মীরসরাইয়ের গিয়াস উদ্দিন, ফটিকছড়ির হোসাইন মো. আবু তৈয়ব, পটিয়া আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চন্দনাইশে আবদুল জব্বার চৌধুরী এবং সাতকানিয়ার আবদুল মোতালেব। এই তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রাম-১০ আসনে সাবেক মেয়র মনজুর আলম, চট্টগ্রাম-১১ আসনে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন এবং বাঁশখালী আসনে মুজিবুর রহমান ও আবদুল্লাহ কবির লিটন। এই ৮টি আসনে নির্বাচনি প্রচারের শুরুর পর থেকেই দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। আসনগুলোতে দিন দিন সংঘর্ষ বাড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
চট্টগ্রাম-১৬
চট্টগ্রাম-১৬ আসন, অর্থাৎ বাঁশখালীতে দুই সংসদ সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের ভেতর থেকে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী সমর্থকদের নিয়ে বের হন। একই সময় উত্তর দিক থেকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান সিআইপির কর্মী-সমর্থকরা এলে উভয়পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ সময় দুই পক্ষের সমর্থকরাই শ্লোগান দেয়ার এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পরে দু’দিক থেকে ইট-পাটকেল ছোঁড়া শুরু হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলীয় অফিসে অবস্থান নেন। আর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই অবস্থিত লক্ষ্মী প্লাজার তৃতীয় তলায় অবস্থান করেন মুজিবুর রহমান সিআইপির কর্মী-সমর্থকরা।
সংঘর্ষ চলাকালে ইট-পাটকেলের আঘাতে মহাজন পাড়া এলাকার নেপাল দাশের পুত্র ২৯ বছর বয়সী রনি দাশ এবং দক্ষিণ জলদী এলাকার আবুল কাসেমের পুত্র ৩২ বছর বয়সী জসীম উদ্দিন আহত হন। তাদের বাঁশখালী হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
বাঁশখালী থানার ওসি মো. তোফায়েল আহমেদ এ ব্যাপারে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে।’
চট্টগ্রাম-১২
চট্টগ্রাম-১২ আসন, অর্থাৎ পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের শান্তির হাট এলাকায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর কর্মী-সমর্থক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় ঈগল (স্বতন্ত্র) প্রতীকের সমর্থক নুরুল ইসলাম নুরু মেম্বারকে মারধর করা হয়। এ ছাড়া মনসা চৌমুহনীতে ব্যানার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, উত্তর হরিণ খাইন বটতলা এলাকায় প্রচারণার গাড়ি ভাঙচুর, গাড়ির যাত্রী ও চালককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
এ আসনের ঈগলের মালিক সামশুল হক চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, ‘মেহেরাটি ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মইনউদ্দিন আদী নামের আমার এক সমর্থককে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলামের সামনে মারধর করেন তারই সমর্থক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, জাকারিয়া, ডালিম, খোরশেদ আলম, মোহাম্মদ হোসেন, রানা, ইমরান, মনা ও জসিম উদ্দিনসহ অন্তত ৫০-৬০ জন। এ সময় তারা আমাদের নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত গাড়ি ভাঙচুর, মাইকের স্পিকার ও ব্যাটারি ভাঙচুর করেন।’
চট্টগ্রাম-১৫
চট্টগ্রাম-১৫, অর্থাৎ সাতকানিয়ার চরতী ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী পক্ষে গণসংযোগ চলাকালে সমর্থকদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ৬ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। ঘটনাটি নিয়ে ইতোমধ্যে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম-৩
এদিক চট্টগ্রাম-৩ আসনের সন্দ্বীপের সারিকাইত এলাকায় নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বাচিপের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর (ঈগল) সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে সংঘাত-সংঘর্ষের আগেই পরিস্থিতি শান্ত হয়।
জমজমাট প্রচারণা
চট্টগ্রাম-১: মীরসরাই আসনে নৌকার প্রার্থী মাহবুব-উর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই প্রচারণার মাঠে সরব রয়েছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপুল কর্মী-সমর্থক নিয়ে ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময়-গণসংযোগে ব্যস্ত হয় পড়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম-২: ফটিকছড়ি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনির পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হোসাইন মো. আবু তৈয়ব এবং আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শাহজাহান সমানতালে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-৩: সন্দ্বীপের এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বাচিপ নেতা মো. জামাল উদ্দিন চৌধুরী প্রচারণায় সমান দাপট দেখাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-৪: সীতাকুণ্ড আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম আল মামুনের শক্ত প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। তারপরও প্রচারে ও গণসংযোগে কার্পণ্য করছেন না তিনি।
চট্টগ্রাম-৫: হাটহাজারীর এ আসনে জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বিপরীতে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-৬: রাউজানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর শক্ত প্রতিপক্ষ একপ্রকার নেই-ই। তিনিও উপজেলাজুড়ে প্রচারে ব্যস্ত।
চট্টগ্রাম-৭: রাঙ্গুনিয়া আসনে নৌকার প্রার্থী তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ আসনেও তার বিপরীতে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তবে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ব্যাপক প্রচারে দিন কাটছে তার।
চট্টগ্রাম-৮: চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই প্রচারণার মাঠে সরব। এই আসনে জাতীয় পার্টির সোলাইমান আলম শেঠও রয়েছেন প্রচারণার মাঠে। অন্যদিকে সরব আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কিষাণ চৌধুরীও।
চট্টগ্রাম-৯: কোতোয়ালীর এ আসনে শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় অনেকটা নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাচ্ছেন বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
চট্টগ্রাম-১০: ডবলমুরিংয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র মনজুর আলম প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই প্রচার ও গণসংযোগ শুরু করেছেন। এ আসনে তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ মাহমুদও বসে নেই।
চট্টগ্রাম-১১: বন্দর-পতেঙ্গা আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ লতিফের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন প্রচারণায় রয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১২: পটিয়া আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর পাশাপাশি নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। উভয়েই সমানতালে লড়ছেন নির্বাচনি মাঠে।
চট্টগ্রাম-১৩: আনোয়ারা আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। তাই খানিকটা নির্ভার হয়েই এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি।
চট্টগ্রাম-১৪: চন্দনাইশের এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নজরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে সমানতালে মাঠ কাঁপাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল জব্বার চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-১৫: সাতকানিয়া আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা নদভীর থেকে প্রচারে পিছিয়ে নেই স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মোতালেব ও তার কর্মী-সমর্থকরা।
চট্টগ্রাম-১৬: বাঁশখালীতে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও আব্দুল্লাহ কবির লিটনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিনজনই নির্বাচনি মাঠে ব্যস্ত। সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাও ছড়াচ্ছে চট্টগ্রামের এই আসনটিতে।