দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চারের লক্ষ্যে রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গাজীপুরের শ্রীপুরে রেললাইন কেটে ট্রেনে নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে এমনটা বলা হয়েছে।
রোববার দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন কমিশনার মো. মাহবুব আলম।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার পরিকল্পনায় গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটে। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের চাপ ও দেশ–বিদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা হয় আজমল ভূঁইয়ার বাড়িতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আটজন মিলে রেললাইনের কিছু অংশ কেটে রাখেন।
এ ঘটনায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাশকতার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী সদস্যরা সবাই বিএনপি এবং তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং সক্রিয় সদস্য বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কার্যালয়ে রোববার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন কমিশনার মো. মাহবুব আলম। ছবি: নিউজবাংলা
গ্রেপ্তার সাতজন হলেন- গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাসান আজমল ভূঁইয়া, জান্নাতুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয়, শাহানুর আলম, সাইদুল ইসলাম ও সোহেল রানা।
এদের মধ্যে আজমল ভূঁইয়া গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। জান্নাতুল ও মেহেদী বিএনপির কর্মী। সোহেল রানা গাজীপুরের কাজী আজিম উদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। শাহীনুর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি, হৃদয় ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাইদুল গাজীপুর সদর থানা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি।
পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘ঘটনার পরপরই গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনিবার জান্নাতুল ইসলামকে আটক করে।
‘জিজ্ঞাসাবাদে জান্নাতুল জানান, ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্যে তারা কোনাবাড়ী থেকে ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একটি হায়েস গাড়ি (মাইক্রোবাস) ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করেন। গাড়িটি নিয়ে তারা গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকেন।’
মাহবুব আলম বলেন, ‘মাইক্রোবাসে থাকা আরোহী সবাই মুখোশ পরা ছিল। এ অবস্থায় ড্রাইভার ভয় পেয়ে তাদের ঢাকায় না যাওয়া ও মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। এ সময় যাত্রীদের একজন মুখোশ খুলে তাকে চেনেন কিনা ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে। ড্রাইভার তাকে চিনতে পারলেও কিছু বলতে সাহস পাননি। পরে তারা ভাড়া করা মাইক্রোবাস নিয়ে রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হয়।’
কমিশনার জানান, মাইক্রোবাসের আরোহীরা গাজীপুর শহরের শিববাড়ীর জোড় পুকুরপাড় এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে উঠায়। পরে তারা গাজীপুর শহরের জোড় পুকুরপাড়স্থ ইবনে সিনহা হাসপাতাল এলাকায় তোহার বাসা থেকে রেললাইন কাটার যন্ত্রপাতি এবং দক্ষিণ সালনার উসমান গণির ভাড়া দেয়া ‘বাঁশ বাগান’ রেস্টুরেন্ট থেকে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে উঠায়। এসব সরঞ্জাম নিয়ে তারা শিববাড়ী মোড় থেকে আরও দুজনকে উক্ত গাড়িতে উঠায়।
এরপর গাজীপুর শহরের ভেতরে বিভিন্ন অলি-গলিতে ঘোরাঘুরি করে রাত ১০টায় শিমুলতলী এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খায়। রাত ১১টায় হোটেল থেকে বের হয়ে ফের গাড়িতে সময়ক্ষেপণের জন্য শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করে।
রাত দেড়টার দিকে ঘটনাস্থল শ্রীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় ৪-৫ কিলোমিটার দূরের বনের পাশে গাডড়ি রেখে হেঁটে তারা গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জামাদি নিয়ে বনখরিয়া চিনাই রেল ব্রিজের পাশে যায়। সেখানে রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল লাইনের ২০ ফুট গ্যাস কাটার দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ভোর ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে রেললাইনের ওই স্থানে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
কমিশনার মাহবুব আরও জানান, নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েই তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশে চারজন গাড়ি থেকে নেমে যায়। বাকি সদস্যরা পরবর্তীতে মিরপুরে গিয়ে নামে। মিরপুরে নেমে তারা নিজেদের কাছে টাকা না থাকায় ফোনে অন্য একজনকে ড্রাইভারের নম্বরে টাকা পাঠাতে বলে। সে অনুযায়ী জনৈক ব্যক্তি ড্রাইভার সাইফুলের বিকাশ নম্বরে ৮ হাজার ১০০ টাকা পাঠিয়ে দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে ১১ ডিসেম্বর রাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক বিএনপি নেতা আজমল ভূঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে সভা হয়। ওই সভায় রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা করা হয়।
ওই সভায় আলোচনা হয় যে, দলীয় উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। এজন্য তারা রেললাইনে নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেয় তারা।
প্রসঙ্গত, রেললাইন কাটা থাকায় বুধবার ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের বনখরিয়া এলাকায় আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে একজন যাত্রী নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হন।