ময়মনসিংহ শহরে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শত শত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাকের ডগায় বসে বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে গেলেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। এতে ক্ষুব্ধ সচেতন মহল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোনো কোনো সময় ধারণ ক্ষমতার চারগুণেরও বেশি রোগী থাকে। অনেক রোগী দ্রুত সেবা পেতে চান। এই সুযোগ কাজে লাগান শহরের বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা। তাদের খপ্পরে পড়ে রোগী যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
এর মধ্যে অনেক নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এগুলোতে মানা হচ্ছে না নীতিমালা। প্রয়োজনীয় জনবল ছাড়াই চলতে থাকা হাসপাতালগুলোতে অনেকে প্রতারিত হন। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয় টাকা।বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগও অনেকটা নিরুপায়।
শহরের চরপাড়া রোডের সেহড়া এলাকায় অবস্থিত সেনা জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে রোগী আসা-যাওয়া করছে। দক্ষ ডিপ্লোমাধারী টেকনিশিয়ান না থাকলেও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। দশ শয্যার এই হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক এবং সার্টিফিকেটধারী সনদপত্র নার্স পাওয়া যায়নি। রোগী এলে চিকিৎসক ও নার্স ডাকা হয়।
সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক কর্মকর্তা মিলে এই হাসপাতালটি পরিচালনা করছে। নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই হাসপাতালটি পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নিয়মিত চলছে চিকিৎসা, হচ্ছে অপারেশনও। সেনাবাহিনীর একসময়ের কর্মকর্তারা হাসপাতালটি পরিচালনা করায় স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অভিযান চালাচ্ছে না। ফলে এই হাসপাতালে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। সুচিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিয়ে পকেটে ভরা হচ্ছে টাকা।
এ ছাড়াও পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াই নানা ত্রুটি নিয়ে চলছে ফাইজা হেলথ কেয়ার সেন্টার, নিউ রুম্পা নার্সিং হোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল, আদিব প্রাইভেট হাসপাতাল, গ্রামীণ প্রাইভেট হাসপাতাল, গাজী প্রাইভেট হাসপাতাল, মহানগর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাসুম ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
ফাইজা নামের ওই প্রতিষ্ঠানে অপচিকিৎসায় জেলার ত্রিশাল উপজেলার চিকনা মনোহর এলাকার জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক মেয়ে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। বেসরকারি এই হাসপাতালটি মানসম্মত না হওয়ায় গত সাত মাস আগে সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল।
গত ১০ জুলাই রাতে নিউ রুম্পা নামে রপ্রতিষ্ঠানে নগরীর পুরোহিতপাড়া এলাকার মো. রাহাতের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে নুসরাত জাহান নূপুরের মৃত্যু হয়। নাকের পলিপাসের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অস্ত্রোপচার টেবিলেই মৃত্যু হয় শিক্ষার্থীর। মৃত্যুর পর তার স্বজনরা হাসপাতালের একটি কক্ষ ভাঙচুর করেন।
জেলা সিভিল সার্জন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয় থেকে জানা যায়, একটি দশ শয্যার বেসরকারি হাসপাতালে তিনজন ডিউটি চিকিৎসক ও ছয়জন নার্স সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। এর চেয়ে বেশি শয্যার প্রতিষ্ঠান হলে দ্বিগুণ ডিউটি চিকিৎসক ও নার্স থাকতে হবে। হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে নিজস্ব ভবনে। পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে হবে। বর্জ্য শোধনাগার থাকাসহ বিভিন্ন নিয়ম মানতে হবে।
সেনা জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হাসপাতালে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক থাকেন না। যখন চিকিৎসক না থাকেন, তখন প্রয়োজন হলে ফোন করে ডেকে আনা হয়। চলতি বছরের লাইসেন্স নবায়নের চেষ্টা করছি। এ ছাড়া অন্যান্য আরও কিছু সমস্যা থাকলেও প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না। তবে হাসপাতালটির সকল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
ফাইজা হেলথ কেয়ার সেন্টারের পরিচালক মো. নূরুল আমিনের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। তবে, নিউ রুম্পা নার্সিংহোম অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক মো. শাহজাহান হোসেন খান বলেন, এই শহরে কোনো হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক নেই, রোগীর চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক এনে অস্ত্রোপচার করানো হয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম বলেন, অনেক বেসরকারি হাসপাতালের সামনে আকর্ষণীয় সাইনবোর্ডসহ বাইরে ফিটফাট থাকলেও ভেতরের পরিবেশ অপরিচ্ছন্ন। দশ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হয় আরও বেশি। দায়িত্বরত কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান না চালানোয় নানা সমস্যায় জর্জরিত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার নামে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অভিযান চালানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক অনার্স অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক ডা. এইচ এ গোলন্দাজ তারা বলেন, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্স আছে কি না দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। তা না হলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম নিয়মে পরিণত হয়।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নানা সমস্যায় জর্জরিত বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসার নামে শুধু চলে বাণিজ্য। কিছুদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হবে। কোনো ত্রুটি কিংবা অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার প্রমাণ মিললে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।