শেরপুরের সীমান্ত এলাকার গারো পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত কয়েকটি এলাকায় মহান বিজয় দিবস পালন করা হয়েছে ব্যতিক্রমী উপায়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ব্যক্ত করতে সারা শরীর কলাপাতায় ঢেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা তুলে বনভোজনের আয়োজন করেন স্থানীয় একদল যুবক।
স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, দেশের মুক্তিকামী মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সীমান্তের ওপারে অবস্থান নেয়। এ সময় গারো পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্কার খনন করে মুক্তিযোদ্ধাদের মারার ফাঁদ পাতে ঘাতকরা, সঙ্গে দিতে থাকে টহল। এ অবস্থায় নানা রূপে সজ্জিত হয়ে সীমান্তের এপারের মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়রা তথ্য নিয়ে পৌঁছে দিতেন ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। কেউ কলাপাতা মুড়ে ভিক্ষুক, কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ বোবা, কেউ আবার পাগল সেজে খবর নিয়ে যেতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। শুধু তথ্য নয়, এভাবে ভিক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধা ও নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য অর্থের যোগানও দিতেন তারা। অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার জোগাড় করতে হতো। এভাবে তথ্য পেয়ে গেরিলা যুদ্ধে এসে বহু পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের হত্যা করে ওই এলাকা শক্রমুক্ত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সেই স্মৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে স্বাধীনতার পর থেকেই বিজয় দিবসের দিন কলাপাতায় মুড়ে ভিক্ষা করে থাকে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিঙ্গাবরুনা ইউনিয়নের শয়তান বাজার, বাবলাকোনা ও হারিয়াকোনা এলাকার শিশু-কিশোররা। এভাবেই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ধরে রাখতে চায়।
মহান বিজয় দিবসের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কলাপাতায় মুড়ে বাড়ি-বাড়ি এবং দোকানে-দোকানে ভিক্ষা করে তা দিয়ে বনভোজনের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয় গৃহিনী রহিমা বেগম বলেন, ‘আমরা শুনেছি, যুদ্ধের সময় আমাদের এলাকায় অনেকেই পাগল সেজে কলাপাতায় মুড়ে ভিক্ষা করত, আর খবর নিয়ে মুক্তি ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। তাই ১৬ ডিসেম্বরে পাগল সেজে ভিক্ষা করতে আসে বাচ্চারা। আমরাও তাদের চাল ও টাকা দেই।
কাঞ্চন মারাক নামের এক যুবক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কলাপাতায় মুড়ে ভিক্ষা করবার আইতো, আর খবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দিত। তখন চাল-ডাল নিয়া খাইতো। পরে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ির কাছে একজন বিহারিকে মাইরা ফেলায়, অন্য বিহারিদেরও মারে। এরপর থেকেই বিজয় দিবসে এ আয়োজন করা হয়। আমরা চাই এটি যেন হারিয়ে না যায়। তাই আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে উৎযাপন করে থাকি।’
এ বিষয়ে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার কাছে জানতে চায় নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতাম। খেতে কাজ করতাম, ল্যাংড়া সাজতাম, কলাপাতায় মুড়ে ভিক্ষুক সাজতাম, পাগল সাজতাম, আরও কত কী! মূলত তথ্য সংগ্রহ করে পরে হামলা করার উদ্দেশ্যেই এমন পরিকল্পনা করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমি চাই, এ কাহিনীগুলো যেন হারিয়ে না যায়। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন আয়োজন করে থাকে, ভবিষ্যতেও যেমন তেমনি করে আয়োজন করা হয়।’
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম জিএম বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজন সবসময় চলমান থাকবে। আমরা এ আয়োজনে সকল ধরনের সাহায্য করে থাকি। সরকারিভাবে একটু সাহায্য করলে এটাকে আরও বড় আকার দেয়া যাবে।’