রাত ১২টা কি সাড়ে ১২টা। আধো ঘুমে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে চোখ মেলেন ৪০ বছর বয়সী নারগিছ। জানালা দিয়ে হঠাৎ একটি আগুনের গোলা আসতে দেখেন। মুহূর্তেই আগুন লেগে যায় মশারিতে৷ জ্বলন্ত মশারিতে পেঁচিয়ে যায় জানালার পাশে থাকা ঘুমন্ত কন্যা মাহিদা জান্নাত তিশা।
১০ বছর বয়সী সন্তানেক বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেন নারগিছ। মশারি থেকে আগুন ছড়িয়ে যায় বিছানায়। আগুনে ঝলসে যায় মা-মেয়ের পুরো শরীর।
গেল ২৮ নভেম্বর রাতে এই ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকায়। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় দুর্ঘটনার প্রায় দশদিন পর।
ঘটনার চারদিন পর ২ ডিসেম্বর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান তারা। মৃত্যুর আগে নারগিছ সেই রাতের ঘটনা বলে যান স্বজনদের।
নারগিছের কোলে মেয়ে মাহিদা জান্নাত তিশা (বাঁয়ে); স্কুল ড্রেসে তিশা। ফাইল ছবি
স্বজনরা ঘটনাস্থলে গিয়ে জানালার পাশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) শক্তিশালী সঞ্চালন লাইন ও ভবন থেকে অনিরাপদ দূরত্বে বৈদ্যুতিক খুঁটি দেখেন। তাই তাদের সন্দেহ, পিডিবির সঞ্চালন লাইনে কোনো গোলযোগ থেকে জানালা দিয়ে নারগিছের দেখা সেই আগুনের গোলা প্রবেশ করেছে। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কথার সঙ্গেও মিলে যায় স্বজনদের সন্দেহ।
গার্মেন্টকর্মী নারগিছ দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে নগরীর বায়েজিদ থানার অক্সিজেন চাঁদনি গলির মুখ এলাকার আল আরাফাত ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। এর আগে ২০১৪ সালে প্রথম স্বামী ইসমাইলের সঙ্গে ডিভোর্স হয় তার। ইসমাইল ও নারগিছের ঘরে দুই ছেলেমেয়ে। দুই সন্তান আদালতের নির্দেশে বাবার সঙ্গে থাকলেও মায়ের বাসায়ও ইচ্ছেমেতা যাতায়াত ছিল।
ঘটনার দিন বিকেলে আড়াইশ মিটার দূরের বাবার বাড়ি থেকে মায়ের কাছে যায় তিশা। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে সে। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে দুর্ঘটনার পর প্রতিবেশীরা মা-মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে ছুটে যান ইসমাইল।
তিনি বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে শুরুতে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে শুনি তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেছে। দ্রুত হাসপাতালে চলে যাই। সেখানে ডাক্তার বললেন, বার্নে আইসিইউ নেই। তাই ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।
‘আমি সকালের মধ্যে দুজনকে একসঙ্গে ঢাকায় নিয়ে যাই৷ সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ তারিখ ভোরে নারগিছ ও সকাল ১০টার দিকে তিশা মারা যায়।’
মৃত্যুর আগে নারগিছ দুর্ঘটনা সম্পর্কে ইসমাইলকে বিস্তারিত জানান। ইসমাইল বলেন, “আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলতাম না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে তো কথা বলতেই হবে। সে বললো, ‘ঘুম ভাঙার পর দেখি হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা আগুনের গোলা আসছে৷ পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেছে। মশারিতে আগুন লেগে গেছে। আর জ্বলন্ত মশারি তিশার গায়ে পেঁচিয়ে গেছে। সেটা টান দেয়ায় আমার গায়েও আগুন লেগে যায়।’ তারা দুজন দগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে যায়। তখন দুজন প্রতিবেশী ছেলে তাদের দেখে হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
ছবির দিকে তাকিয়ে স্বজনহারা। ছবি: নিউজবাংলা
শুক্রবার সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মাহাসড়কে অক্সিজেন এলাকার চাঁদনী গলির মুখে পাঁচতলা আল আরাফাত ভবন। ওই ভবনের সামনের (উত্তর-দক্ষিণ) দেয়াল ঘেঁষে চলে গেছে পিডিবির ৩৩ হাজার কিলোভোল্টের সঞ্চালন লাইন।
আবার ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষা দুটি খুঁটি থেকে একটি ১৩ হাজার কিলোভোল্টের সঞ্চালন লাইন চলে গেছে পূর্বদিকে। তাছাড়া ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষা খুঁটি দুটিতে একটি ট্রান্সফরমারও দেখা গেছে। তবে ওই ট্রান্সফরমারের তিনটি ফিউজই বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পিডিবির শক্তিশালী সঞ্চালন লাইনের তার রীতিমতো ঘিরে রেখেছে ওই ভবন।
ট্রান্সফরমারের কয়েক ফুট উপরে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলোর সঙ্গে লাগোয়া বাসায় থাকতেন নারগিছ। ওই বাসার দুটি জানালাই দক্ষিণ পাশের দেয়ালে- একটি রান্না ঘরের এবং অন্যটি নারগিছের কক্ষের। দুই জানালার মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, খুঁটি ও ট্রান্সফরমারের কাছাকাছি রয়েছে রান্না ঘরের জানালা। দুর্ঘটনার পর কাঁচ ভাঙা ছাড়াও ওই জানালের নিচের দিকের পাত উঠে অনেকটা দূরে চলে গেছে। নারগিছের কক্ষের জানালার পাতও কিছুটা উঠে গেছে। তবে এটি তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসমাইলের দাবি, পিডিবির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের খুঁটি বা তারে কোনো গোলযোগ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জানালা দিয়ে ঢুকেছে বাসায়। সেখান থেকেই আগুন লেগেছে মশারিতে।
তিনি বলেন, ‘সঞ্চালন লাইনের তিনটি তারের মধ্যে একটি রুমের কাছাকাছি। তাছাড়া খুঁটিও কাছে। সেখানে কোনো গোলযোগের কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে। আর ওই বিস্ফোরণ থেকে জানালা দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাসায় ঢুকেছে৷ সেখান থেকেই মশারিতে আগুন লেগেছে৷ আগুন কিন্তু বেশি না। বাসার কিছু কাপড়-চোপড় ছাড়া বাকি সব তো ঠিক আছে দেখা যাচ্ছে।’
ঘটনার সময় ওই বাসার জানালার ঠিক নিচে একটি টিনের ছাদওয়ালা টঙ দোকানের বেঞ্চে বসে ছিলেন স্থানীয় সবজি ব্যবসায়ী আসাদ। তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ তীব্র বিস্ফোরণ হয় আমার মাথার উপর। বিস্ফোরণের পর মাথার ওপর টিনের ছাদে ঝনঝন করে কিছু পড়ার শব্দ পেয়েছিলাম। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হবে হয়তো। সেদিন উপরে টিন না থাকলে হয়তো আমারও মৃত্যু হতো।’
তবে ওই ভবনের কেয়ারটেকার রফিক ও ভবনের নিচে থাকা পান দোকানি আব্দুল গনির দাবি, বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ভবনের পাশে থাকা ট্রান্সফরমারে। মাঝেমধ্যেই ওই এলাকায় ট্রান্সফরমারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
পিডিবির খুঁটি কিংবা ট্রান্সফরমার- বিস্ফোরণ যেখানেই হোক না কেন এর পেছনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
তবে নিজেদের দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে পিডিবি। পিডিবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘এরকম কোনো ঘটনা আমি শুনিনি। আমাদের বিদ্যুৎ লাইন থেকে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না৷ তাছাড়া ট্রান্সফরমার থাকলেও সেটার বিস্ফোরণে এত উপরে (তৃতীয় তলার সমান উচ্চতায়) সমস্যা হওয়ার কথা না। তবে আমরা খোঁজ নেব, আমি লোক পাঠাব সেখানে।’
দুর্ঘটনার বিষয়ে বায়েজিদ বোস্তামি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ওইদিন ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন পাইনি৷ মা-মেয়ে দগ্ধ ছিল, তাদেরও পাইনি। মূলত বিদ্যুতের তার (সঞ্চালন লাইনের) থেকে কিছু একটা ঘটেছে।’
মেয়ে তিশাকে নিয়ে এই খাটেই ঘুমিয়ে ছিলেন নারগিছ। ছবি: নিউজবাংলা
এর আগে ২০ নভেম্বর বন্দর নগরীর বায়েজিদ থানার বালুচরা এলাকায় কোচিং করতে গিয়ে ভবনের সঙ্গে লাগোয়া পিডিবির সঞ্চালন লাইনে স্পৃষ্ট হয়ে দগ্ধ হয় স্কুলছাত্র আবির হোসেন। এর তিনদিন পর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। আবির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কে শহরমুখী লেনের পাশ দিয়ে যাওয়া সঞ্চালন লাইনে।
বছর দেড়েক আগে সড়কটি প্রশস্ত করায় সঞ্চালন লাইনটি সড়ক থেকে আরও দূরে সরাতে হয়। এতে সড়কের পাশে থাকা বেশ কয়েকটি ভবন বিপজ্জনকভাবে ঘেঁষে স্থাপন করা হয় লাইনটি। এতে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ।
এই দুর্ঘটনার ৭ দিন পর ২৭ নভেম্বর একই এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করতে গিয়ে পিডিবির উপ-সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান এক শ্রমিক। সবশেষ মারা যান গার্মেন্টকর্মী নারগিছ ও তার মেয়ে তিশা৷
পিডিবির অবহেলা ও তদারকির অভাবে ২০ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর- এই ৮ দিনে পিডিবির একই সঞ্চালন লাইনে দুটি ও এই লাইনের একটি উপ-সঞ্চালন লাইনে একটিসহ মোট তিনটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চারজন।