নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন রেহেনা আক্তার। বড় বোন, ভগ্নিপতি, তাদের ছেলেসহ পাঁচজন কাজ নেন তাজরীন ফ্যাশনসে। পরিবারের সবাই কাজ করতেন চতুর্থ তলায় একই সেকশনে।
১১ বছর আগে সেই দিন সন্ধ্যায় রেহেনার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগলে মুহূর্তেই চারতলা থেকে লাফিয়ে বাঁচেন তিনি, তবে প্রাণে বাঁচেনি তার পরিবারের চার সদস্য। পুড়ে অঙ্গার রেহেনার স্বজনদের দেহ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করতে হয়েছিল।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডির বার্ষিকীতে পোশাকশ্রমিকরা জড়ো হন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে। পুড়ে যাওয়া প্রিয় কর্মস্থল তাজরীন ফ্যাশনসের নয় তলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আজও স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তারা। পরিবারের একাধিক সদস্যকে হারানো অনেকেই কেবল চোখের জল ফেলেন।
শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসনের আশায় এত বছর ধরেও আশায় বুক বেঁধে আছেন তারা।
বার্ষিকীর আগের দিন বৃহস্পতিবার তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে গিয়ে দেখা মেলে বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী বেশ কয়েকজন শ্রমিককে। তাদেরই একজন সেই ঘটনায় পরিবারের চারজন হারানো রেহেনা আক্তার।
সিক্ত চোখে রেহেনা বলেন, ‘আমি, আমার বড় বোন, দুলাভাই, তাদের ছেলে ও তার স্ত্রী তাজরিন গার্মেন্টেসে কাজ করতাম। ওই দিন আমরা সবাই তিন তলায় আর দুলাভাই ফিনিশিং সেকশনে প্যাকিংম্যানের কাজ করছিলেন অন্য ফ্লোরে। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে পুরো কারখানা ধোঁয়ায় ভরে যায়। চারদিকে ধোঁয়ার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তখন কে কোন দিকে যাচ্ছিল বোঝার উপায় ছিল না। ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
‘কোনো রকমে ওড়না দিয়ে মুখ বাঁধছিলাম। এরপর আমাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলছে না আমি নিজেই লাফ দিছি বলতে পারি না। হাসপাতালে তিন দিন পর জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি, আমার বড় বোন, দুলাভাই, তাদের ছেলে ও তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই। পরে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশ সনাক্ত করে জুরাইনে দাফন করা হয়। আজও তাদের মনে হলে ভিতরটা কেঁদে ওঠে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আর কারখানার সামনে আসলে চোখ বেয়ে অজান্তেই পানি চলে আসে।’
রেহেনা আরও বলেন, ‘ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে আমার মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের হাড়ে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছি। এখন নতুন করে ওইসব জায়গা ফুলে গেছে। এতদিন সরকারি হাসপাতালে সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা করিয়ে আসছি, কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে যেতে যেতে হয়তো আমার প্রাণটাই চলে যাবে। আর টাকার অভাবে সন্তাদেরও পড়াশোনা করাতে পারছি না। বাসা ভাড়ার জন্য মালিক নানা খারাপ কথা শোনায়। আসলে আমার বেঁচে থাকাটাই যেন এখন পাপ। এটা কোনো জীবন হলো? পয়সা ছাড়া যেমন চলে না, তেমনি আমার জীবনটাও এখন অচল।’
ওই সময় রেহেনা বলেন, ‘সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যাতে আমাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলে তাজরীনের শ্রমিকরা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাব।’
এ বিষয়ে বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বিন্দু বলেন, ‘আজকে ১১ বছর পার হলো। এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের পুড়িয়ে হত্যার বিচার হলো না। এমনকি হতাহত পরিবার ও তাদের স্বজনরা আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র এবং সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানজনক কোনো সহযোগিতা পায় নাই।
‘শ্রমিকরা যা পেয়েছে তা বৈদেশিক ও এনজিওভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম থেকে পেয়েছে, যেটা যথার্থ নয়। আমরা শ্রমিক সংগঠনগুলো বরাবরই সরকারের কাছে বলে আসছি, হতাহত শ্রমিক পরিবারকে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য। এতদিন পরে এসেও রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধানের কাছে আমরা এই দাবিই জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি তুহিন চৌধুরী বলেন, ‘তাজরীন ট্র্যাজেডির ১১ বছর পূর্তিতে এসে আমরা বলতে চাই, যে শ্রমিকদের মাধ্যমে আজ দেশের পোশাক শিল্প সমৃদ্ধ, সেই শ্রমিকরা যারা আগুনে পুড়ে মারা গেল, তাদের জন্য আমরা আসলে কি করতে পারলাম? সরকার, বিজিএমইএ, মালিকপক্ষ কী দিল? ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা আজও দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছে। তাদের সন্তাদের পড়াশোনা করাতে পারছে না। নানা সমস্যায় তারা এতদিন ধরেই ভুগছে।
‘আসলে তাদের দিকে দেখা কার দায়িত্ব? তাই আমরা বলতে চাই, তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক যারা পঙ্গুত্ব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তাদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে প্রতি মাসে এসব শ্রমিকদের আর্থিক সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।’
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ১১১ শ্রমিক। এ ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শতাধিক শ্রমিক।