হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার আখ্যা দিয়ে এর নামে স্বাধীনভাবে মানুষের চলাফেরায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের আগের দিন শনিবার রাতে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
হাবিবুর বলেন, ‘হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতাল পালন করা যেমন একটি গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি হরতাল না পালন করাও একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতালের নামে অনেক ধরনের নৈরাজ্য চালানো হয়ে থাকে।
‘আগামীকাল (রোববার) হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। কেউ যদি হরতালের নামে মানুষের স্বাধীন চলাফেরার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, তাহলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে তিন দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার দিনভর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিস্থিতি তুলে ধরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আজ (শনিবার) পল্টন ও এর আশপাশ এলাকায় বিএনপিসহ আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ছিল। অনুমতি গ্রহণের সময় বিএনপি নেতৃবৃন্দ নিজেরাই উল্লেখ করেন যে, বিজয়নগর থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত তারা এক থেকে এক লাখ ২০ হাজার লোকের জমায়েত করবেন। তাদের সমাবেশে কেউ যেন বাধাগ্রস্ত না করে এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড না চালাতে পারে, সে জন্য পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সার্বিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কিন্তু সকাল ১০টা নাগাদ বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মী কাকরাইল মোড় ও এর আশপাশে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা এ সময় বিনা কারণে বাস ও বিভিন্ন যানবাহনে ভাঙচুর করে।
‘এর কিছুক্ষণ পর তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে অতর্কিত হামলা করে এবং গেট ভেঙে ফেলে। একপর্যায়ে লাঠিসোঁটা হাতে বাসভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সেখানেও ভাঙচুর চালায়। অতঃপর পুলিশি বাধার মুখে তারা বাসভবন থেকে বের হয়ে যায়। এরপর তারা পার্শ্ববর্তী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বাসভবন জাজেস কমপ্লেক্সে আক্রমণ চালায় এবং রিসেপশন কক্ষে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। এ ছাড়া জাজেস কমপ্লেক্সের সিসিটিভি ক্যামেরাসহ আশপাশের পুলিশের শত শত সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে।’
হাবিবুর বলেন, ‘একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে দুষ্কৃতিকারীরা কাকরাইল মোড় থেকে নাইটিঙ্গেল মোড়ে পর্যন্ত বেশ কিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া আইডিইবি ভবনের ভিতরে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে। তারা নাইটিঙ্গেল মোড়ে বাসে অগ্নিসংযোগ করে। উইলস লিটলস ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে তারা দুইজন পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে প্রহার করে। এই দুই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু নিশ্চিত মনে করে তারা ক্ষান্ত হয়। একই সঙ্গে তারা রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আক্রমণ চালায় এবং ভেতরে ঢুকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ করার পর একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সসহ ২৬টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
‘তারা রমনা ট্রাফিক ডিসির অফিসে ভাংচুর করে এবং অনেকগুলো দোকানে ভাংচুর করে। অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে এবং পুলিশকে সেখানে আক্রমণ করে। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ লাইনের ভেতরে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ভাঙচুর চালায়। ধ্বংসযজ্ঞের একপর্যায়ে তারা বক্স কালভার্ট রোডে একজন পুলিশকে পিটিয়ে চাপাতি দিয়ে মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। মৃত্যু নিশ্চিত করেও ন্যক্কারজনকভাবে ওই পুলিশ সদস্যকে লাথি মারতে থাকে। এ ছাড়া তারা পল্টন থানায়ও আক্রমণ করার চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, ‘তারা ট্রাফিক বক্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তিন ঘণ্টা ধরে চলা তাদের ধ্বংসযজ্ঞে পুলিশ ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এবং আক্রমণকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় শতাধিক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শর্তসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য আইন অমান্যকারীদের প্রতি ধিক্কার জানাই।
‘যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের যথাযথভাবে আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাব এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেই লক্ষ্যে ডিএমপি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে।’
কাকরাইল মসজিদ এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘কাকরাইল মসজিদের সামনে পুলিশের যেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল, আমরা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সেই রকমই ব্যবস্থা রাখি। এখানে অতিরিক্ত ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল না। যতটুকু প্রয়োজন ছিল, আমরা ততটুকু রেখেছিলাম এবং পরে কিন্তু পুলিশের অনেক ফোর্স ছিল।’
সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা আমাদের বন্ধু, সাংবাদিকরা জনগণের বন্ধু। এই ঘটনাটি যেহেতু ব্যস্ততার কারণে আমার নজরে এখনও আসেনি, যদি সেই ধরনের কোনো ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা সেটির জন্য নেয়া হবে।’
বিএমপিকে ও জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে প্রায় ১৪টি দল। সকলকেই কিন্তু আমরা অনুমতি দিয়েছি এবং আমরা আশা করেছিলাম সবাই শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তাদের সমাবেশ করবে। বিএনপি লিখিত দিয়েছে এবং আমরা শর্ত দিয়েছি। সেই শর্ত মেনে নিয়েই তারা সমাবেশ করতে এসেছে।
‘অন্যান্য দলগুলোকেও আমরা চেষ্টা করেছি নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। আমরা সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি, পুলিশি নিরাপত্তা রেখেছি। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে যাতে তাদের সমাবেশ সুন্দরভাবে করতে পারে।’