বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিতে ভারতের শাড়ি ব্যবসায় ধস

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ৪ অক্টোবর, ২০২৫ ২৩:২১

মোহাম্মদ আহমদ আনসারি সারা জীবন কাটিয়েছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসির সরু আর ভিড়ভাট্টার অলিগলিতে। এ শহরকে অনেকেই ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলে থাকেন। এখানকার পার্লামেন্টারি আসনও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। ৫৫ বছর বয়সি আনসারি কয়েক দশক ধরে বুনছেন বেনারসি শাড়ি। তাঁতের শব্দ, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর আজানের সুরে মিশে থাকা এ শহরে তিনি ভালোবাসেন নিজের কাজের পরিবেশ।

ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষের প্রাচীনতম নগরী হলো বারানসি। খ্রিষ্টপূর্ব ১ হাজার ৮০০ সাল থেকেই এ নগরীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়। এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শাড়ির বিক্রি কমেছে। নানা কারণে এ মন্দা দেখা দিলেও সর্বশেষ ধাক্কা এসেছে ভারত-বাংলাদেশের চলমান টানাপড়েন থেকে।

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেন। এর পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এখন অনেকেই মনে করেন, তাদের সমস্যার পেছনে ভারতেরও ভূমিকা আছে। বিশেষ করে মোদির প্রকাশ্য সমর্থন ছিল হাসিনার প্রতি। তার পতনের পর বাংলাদেশে কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। কারণ, তাদের হাসিনার সমর্থক হিসেবে দেখা হতো।

একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতীয় ব্যবসাও বয়কট হয়েছে। কোথাও কোথাও হামলার শিকারও হয়েছে ভারতীয় পণ্যের বিক্রেতারা। দেশটি এখন দিল্লির কাছে দাবি তুলেছে—হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হবে, যাতে তাঁকে দেশে আইনের মুখোমুখি করা যেতে পারে।

চলতি বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ ভারত থেকে কিছু পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দেয়। এর মধ্যে ছিল সুতা আর চাল। পরে ১৭ মে ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। তারা স্থলসীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাত খাবার আমদানি বন্ধ করে দেয়। যদিও বাংলাদেশ থেকে এখনো শাড়ি ভারতে পাঠানো যায়, তবে সেটা কেবল সমুদ্রপথে, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

বিশ্বজুড়ে পরিচিত বেনারসি শাড়ি। সূক্ষ্ম কারুকাজ, বিলাসবহুল রেশম, ঝলমলে জরি আর সোনার-রুপার তারের কাজের জন্য এগুলো বিখ্যাত। একটি শাড়ি বুনতে কখনো কখনো ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। নকশা ও উপকরণের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি শাড়ির দাম দাঁড়াতে পারে এক লাখ রুপি (প্রায় ১ হাজার ১৩০ ডলার) বা তারও বেশি।

আনসারি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে উৎসব আর বিয়েতে এসব শাড়ির অনেক চাহিদা থাকে। কিন্তু আমদানি বন্ধের কারণে ব্যবসা এখন অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।’

ভারতের বারাণসীর কিছু ব্যবসায়ী এখনো বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা পাওনা। ছবি: আল জাজিরা

ভারতের বারাণসীর কিছু ব্যবসায়ী এখনো বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা পাওনা। ছবি: আল জাজিরা

বেনারসি শিল্প এর আগেও একের পর এক ধাক্কা খেয়েছে। নোটবন্দি (ভারতের ১০০০ রুপির নোট বাজার থেকে তুলে নেওয়া), বিদ্যুতের দাম বাড়া, করোনাভাইরাস মহামারি—এসব তো আছেই। পাশাপাশি আধুনিক পাওয়ার লুমে তৈরি সস্তা শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বেনারসি। বিশেষ করে গুজরাটের সুরতে তৈরি শাড়ির কারণে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।

এই ধারাবাহিক সংকটে অনেকে পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। একসময় যেখানে প্রায় চার লাখ তাঁতি ছিলেন, এখন তা নেমে এসেছে অর্ধেকে—প্রায় দুই লাখে। অনেকেই শহর ছেড়ে চলে গেছেন অন্য কাজে। কেউ কেউ আবার রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

৬১ বছর বয়সী এক পাইকারি শাড়ি ব্যবসায়ী পবন যাদব আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ঢাকায় সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার শাড়ি পাঠাতাম। এখন সব থমকে আছে।’ তিনি জানান, প্রতিবেশী দেশের ক্রেতাদের কাছে তার এখনো ১৫ লাখ রুপি (প্রায় ১৭ হাজার ১৪০ ডলার) পাওনা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সে টাকা ফেরত পাওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছে।

ভারতে শাড়ি পরার নথিভুক্ত ১০৮ রকম পদ্ধতি আছে। আর শাড়ি শুধু পোশাক নয়, বরং সূক্ষ্ম নকশা আর রঙের ছটায় একে ধরা হয় চিরন্তন সৌন্দর্য আর ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।

ভারতের টেক্সটাইল খাত এখন নানা সংকটে থাকলেও কৃষির পর সবচেয়ে বেশি মানুষ এই খাতে কাজ করেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখানে কাজ করেন সাড়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে শাড়ির বাজারের মূল্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি রুপি বা ৯ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলার। শুধু রপ্তানি খাতেই আয় হয় প্রায় ৩০ কোটি ডলার।

বারানসির তাঁতি আর ব্যবসায়ীরা টানা তৃতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন। এখন তাঁরা অপেক্ষা করছেন, বাংলাদেশকে ঘিরে তৈরি হওয়া বাণিজ্যসংকটের একটা সমাধান যেন প্রধানমন্ত্রী করেন। ২০১৫ সালে মোদি সরকার ৭ আগস্টকে জাতীয় হ্যান্ডলুম দিবস ঘোষণা করে। তখন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, দেশি তাঁতিদের জীবনে পরিবর্তন আনা হবে, দেশীয় পণ্যের প্রচার করা হবে। কিন্তু তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এত দিনেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

সেভ দ্য লুম—নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা রমেশ মেনন ‘ভারতের তাত শিল্প অনন্য, এর সঙ্গে অন্য কোনো দেশের তুলনা হয় না। তবু নিয়মিত ব্যবসা বা টেকসই আয় না থাকায় অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন নতুন তাঁতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।’ তার মতে, এখন দরকার তাতের পণ্যকে দারিদ্র্যের প্রতীক না বানিয়ে বিলাসপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা।

পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের স্বস্তি

অন্যদিকে বারানসি থেকে ৬১০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা পশ্চিমবঙ্গে চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশ থেকে শাড়ি আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার সুতি শাড়ির ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। শান্তিপুরের ব্যবসায়ী তারকনাথ দাস চার দশক ধরে সুতি শাড়ির ব্যবসা করছেন। স্থানীয় তাঁতিদের তৈরি শাড়ি তিনি দেশের নানা শো-রুমে সরবরাহ করেন। কয়েক বছর ধরে ক্ষতির মুখ দেখলেও দুর্গাপূজার আগে হঠাৎই বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় তিনি খুশি।

আল-জাজিরাকে ৬৫ বছরের এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাংলাদেশি শাড়ি আমাদের বাজারের অন্তত ৩০ শতাংশ দখল করে নিয়েছিল। এতে স্থানীয় শিল্প ভুগছিল। এখন আমরা ধীরে ধীরে আগের বাজার ফিরে পাচ্ছি। এবারের দুর্গাপূজায় বিক্রি গত বছরের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ বেশি হয়েছে।’

শান্তিপুরে এক লাখের বেশি তাঁতি ও ব্যবসায়ী রয়েছেন। পূর্ব ভারতের শাড়ির ব্যবসার অন্যতম বড় কেন্দ্র এই শহর। নদীয়া জেলার এই অঞ্চল সুতি শাড়ির জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে শান্তিপুর সুতি শাড়ি দেশজুড়ে জনপ্রিয়। পাশের হুগলি ও মুর্শিদাবাদ জেলা থেকেও সুতি শাড়ি উৎপাদন হয়। এগুলো শুধু দেশের বাজারেই নয়, গ্রিস, তুরস্কসহ নানা দেশে রপ্তানি হয়।

নদীয়া জেলার পাইকারি ব্যবসায়ী সঞ্জয় কর্মকারও খুশি এ পরিস্থিতিতে। তার ভাষায়, ‘বাংলাদেশি শাড়ি আমাদের চেয়ে একটু ভালো কাপড়ে তৈরি হয়। সঙ্গে থাকে আকর্ষণীয় প্যাকেজিং। তাই স্থানীয় নারীরা সেগুলো কিনতে পছন্দ করতেন।’ তিনি জানান, তরুণীরা আবার আধুনিক পোশাক—লেগিংস, টপস বা টিউনিকের দিকে ঝুঁকেছেন। তাতে শাড়ির বাজারে ধাক্কা লেগেছিল।

ফ্যাশন ডিজাইনার শান্তনু গুহঠাকুরতা মনে করেন, বাংলাদেশের শাড়ি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা ভারতের তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য বড় সুবিধা বয়ে এনেছে। এতে শুধু মূল বাজারই সুরক্ষিত হয়নি, নকল ডিজাইনের সস্তা শাড়িও কমে গেছে। ‘দুর্গাপূজার আগে এ সিদ্ধান্ত আসায় শিল্পকে আরও বেশি সহায়তা করেছে’—তিনি বলেন।

এ বিভাগের আরো খবর