সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত এম. সাইফুর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। সাইফুর রহমান তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ডিপ্লোমেটিক লিডার’ হিসেবে। পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ারেই সেই কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন আরিফ।
টানা দশ বছর সিসিক মেয়রের দায়িত্ব পালন শেষে বিদায়বেলায়ও আরেকবার তার প্রমাণ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন, সরকারি বরাদ্দের অপব্যয় আর দুর্নীতির অভিযোগ এনে সিলেট আওয়ামী লীগ নেতারা যখন আরিফের সমালোচনায় মুখর তখন শুক্রবার তার বিদায় সংবর্ধনায় হাজির হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. একে আব্দুল মোমেন তার ভূয়সী প্রশংসাই করলেন।
গত বছর বন্যার সময়ে সিলেটে এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা থামিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও মেয়র আরিফের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘মেয়র ভালো, কাজপাগল।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আরিফুল হক সিসিকের একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তবে সাইফুর রহমানের আশীবার্দপুষ্ট হয়ে তখন সিলেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হন তিনি। অবশ্য সে সময় ব্যাপক দুর্নীতিরও অভিযোগ ওঠে আরিফের বিরুদ্ধে।
১/১১ উদ্ভূত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা দেশের শীর্ষ ৫০ দুর্নীতিবাজের তালিকায়ও উঠে আসে আরিফের নাম। সে সময় গ্রেপ্তারও হন তিনি।
আরিফুল হক এরপর কিছুদিন রাজনীতির আড়ালে চলে যান। ২০১৩ সালে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে আবার উত্থান ঘটে তার। সেবার আওয়ামী লীগের শাসনামলে তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৩ সালের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে টানা ১০ বছর ধরে সিসিক মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন আরিফ।
নিজে বিএনপি দলীয় নেতা হলেও আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং তার ভাই বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবুল মোমেনের সঙ্গে আরিফের সখ্য নগরজুড়েই আলোচিত। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এই সখ্য তার মেয়রের দায়িত্ব পালন ও সরকারি বরাদ্দ প্রাপ্তিকে সহজ করেছে।
তবে বিএনপিদলীয় মেয়রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রীদের এ সখ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের নেতাদের মধ্যেই ক্ষোভ ছিল, এখনও আছে।
দলীয় নির্দেশনা মেনে এবারের সিটি নির্বাচনে অংশ নেননি আরিফুল হক। ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আরিফুল হক চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব শেষ হচ্ছে আগামী ৭ নভেম্বর। ৮ নভেম্বর দায়িত্ব নেবেন নবনির্বাচিত মেয়র।
দায়িত্ব ছাড়ার আগে শুক্রবার মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে ‘নাগরিক সংবর্ধনা’ দেয় সিসিক। এই প্রথমবার সিলেট সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়রকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়। এর আগে টানা দুই দফা মেয়রের দায়িত্ব ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। শেষবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালেই দায়িত্ব ছাড়েন তিনি।
কিন্তু কামরানের জন্য কোনো সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়নি। অপরদিক বিএনপি নেতা আরিফুল হককে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু।
ওই সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রশংসা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তিনি সরকারি বরাদ্দের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। মেয়র থাকাকালীন দুই মেয়াদে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগর উন্নয়নে সদা সচেষ্ট ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘মেয়র আরিফ হলেন আওয়ামী বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাংলাদেশের উন্নয়ন। আর এই উন্নয়নের মহাসড়কে আমাদের বিএনপির মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অত্যন্ত শক্তিশালী সহযোগী। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
মেয়রকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীর এমন প্রশংসায় ক্ষোভ বিরাজ করছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও।
এ নিয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী দিপন ফেসবুকে লিখেন, ‘সংবর্ধনা ও প্রশংসাপত্রের রাজনীতিতে নাগরিকদের কোনো দায় নেই। নগরজুড়ে অব্যবস্থাপনা, অপরিকল্পিত প্রকল্পের দরুন নগরে জলাবদ্ধতা, তার ফলে বারংবার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, নানা ভোগান্তির শেষ নেই। আধুনিক নাগরিক সেবার অভাব, অতিরিক্ত কর আদায়- এসব নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ আছে।
‘দেশের অন্যান্য নগরের তুলনায় বহুলাংশেই পিছিয়ে আছে সিলেট। বহু অব্যবস্থাপনার সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগও ব্যাপক। আছে সিন্ডিকেটিজমের অভিযোগ। এসব দায় মাথায় নিয়ে তাকে যেতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রথম মেয়াদে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। বিশেষত সড়ক সম্প্রসারণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার, ছড়া উদ্ধার ও সৌন্দর্য বর্ধনে তার গৃহীত প্রকল্প প্রশংসা পায়। নগরে জনপ্রিয়তাও বাড়ে আরিফের। সেই জনপ্রিয়তায় ভর করে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি।
তবে সিলেটে গত বছরের ভয়াবহ বন্যার পর থেকেই আরিফের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বন্যার পর থেকেই ভারি বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেট নগরে। এতে ছড়া-খাল উদ্ধারে বিপুল অংকের ব্যয় ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। তার বিরুদ্ধে অপরিকল্পিত উন্নয়নের অভিযোগ আনা হয়। প্রশ্ন তোলা হয় উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়েও।
গত সিটি নির্বাচনে প্রচারণার সময় আরিফের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপক সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আরিফের বিরুদ্ধে ‘প্রকল্পবাজির’ অভিযোগও আনা হয়। তার অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসী দুর্ভোগ পোহাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
মেয়রকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশংসা প্রসঙ্গে সিলেট আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কারও সংবর্ধনায় গেলে তো দু-চারটা ভালো কথা বলতেই হয়।
‘মেয়র আরিফ যে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করেছেন তা এখন নগরবাসী হারে হারে টের পাচ্ছে। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়। সড়ক সম্প্রসারণ হলেও যানজট বেড়েছে। ফুটপাত দখলমুক্ত হয়নি। সারাবছর খোঁড়াখুঁড়ি করে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়িয়েছেন আরিফ।’
তবে একে সিলেটের রাজনীতির সৌন্দর্য উল্লেখ করে সিলেটের নাগরিক সংগঠক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রশংসা করে সিলেটবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন। ওনারা দুইজন পরস্পরের প্রতি সম্মান ও সৌহার্দ্য প্রকাশ করে সারাদেশে রাজনীতিতে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।’