বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সাগরে মিশে যাচ্ছে ২৯৩ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ

  • রহিম সৈকত , আনোয়ারা ও বাঁশখালী (চট্টগ্রাম)    
  • ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ১৮:৫০

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সাঙ্গু নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর ড্রেজিংয়ের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন মন্ত্রীকে জানানো হয়েছে।  বিআইডব্লিউটিএ পরিদর্শক দল খুব তাড়াতাড়ি পরিদর্শনে আসবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এরপর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেলে বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধ করা যাবে।’

চট্টগ্রামের পশ্চিম বাঁশখালীর মানুষের প্রাণের দাবি একটি টেকসই বেড়িবাঁধ। কিন্তু তাদের সেই দাবি পূরণ হচ্ছে না কোনোভাবেই। বিদ্যমান বাঁধটুকুও অস্তিত্ব হারাচ্ছে। কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধটি সাগরের বুকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া এলাকায় সাগর বুকে দিনে দিনে মিলিয়ে যাচ্ছে বেড়িবাঁধ। প্রকল্প কাজে ধীরগতি ও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী এর বড় কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে।

বেড়িবাঁধ না থাকার কারণেই ১৯৯১ সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে এই জনপদে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরপর ঘূর্ণিঝড় আয়লা, সিডর, কোমেন, রোয়ানুর কবলে পড়ে প্লাবিত হয়ে শত শত একর ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে ব্লক তৈরি ও লুটপাট-দুর্নীতি বেড়িবাঁধ টেকসই না হওয়ার অন্যতম কারণ। উপকূলীয় এই বেড়িবাঁধ নিমাণ কাজের বাজেট যা ছিল তা কেবল ছোট থেকে ছোট হয়ে এসেছে। এসব ঢাকতে অপরিকল্পিত নকশা প্রণয়ন ও যেনতেনভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে মাত্র এক বছরের মাথায় তা হারিয়ে যাচ্ছে সাগর বুকে।

অনেকের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে সাঙ্গু নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। আর নতুন গতিপথে স্রোত এখন সরাসরি আঘাত হানছে বেড়িবাঁধে। প্রবল স্রোতের ধাক্কায় বাঁধের কিনারাতে তৈরী হচ্ছে গভীর খাড়ি (কূপ)। তা ক্রমশ বেড়িবাঁধের ভিত নড়েবড়ে করে দিয়ে ভাঙন ত্বরান্বিত করছে।

স্থানীয়রা বলছেন, স্রোতের গতিপথ বদল, চর জেগে ওঠা- এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের। তারা এটার সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ টাইপের কাজ কেন করবে? আর তার খেসারত কেন উপকূলবাসী দেবে?

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সাড়ে ৭ বছর আগে ২৫১ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৯ মে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) তা পাস হয়। বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই বাঁধ নির্মাণে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়। ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় এতে ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ভাঙন রোধ ও পুনরাকৃতিকরণের পাশাপাশি ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ এবং ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতিকরণের কথা রয়েছে। ২০২২ সালে প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া এলাকার মধ্যবর্তী দুটি স্থান ধসে গিয়ে বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ অংশ সাগরে মিলিয়ে গেছে। সিসি ব্লক বেষ্টিত বাঁধের যেটুকু টিকে আছে তাতে বিশালাকার ফাটল সৃষ্টি হয়ে নিচের দিকে ক্রমশ দেবে যাচ্ছে।

ভারী কোনো জোয়ার এলেই পুরোপুরি মিশে যাবে বেড়িবাঁধের এই অংশটুকু। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি হলে তড়িঘড়ি করে জিও ব্যাগ ফেলে বিষয়টি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে পাউবো। অধিকন্তু জিও ব্যাগ ভর্তি করা হচ্ছে বাঁধের খুব কাছ থেকে বালু নিয়ে। আবার কোথাও ২০০ মিটার দূরত্বে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে জিও ব্যাগ পূর্ণ করার জন্য।

সম্প্রতি সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় সৃষ্ট বন্যার পানি সাঙ্গু হয়ে নেমে এসেছে বঙ্গোপসাগরে। বলতে গেলে এরপর থেকে এই বাঁধে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তবে, এই জিও ব্যাগ ভাঙন কতটা ঠেকাতে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দিহান এলাকার সচেতন মহল।

পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন কফিল বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি একটি টেকসই বেড়িবাঁধ। কোনো বড় জোয়ার এলে বা আবহাওয়ার ভারি পূর্বাভাস পেলে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি বেড়ে যায় আমাদের মধ্যে। এই আতংক আমাদের সারাজীবনের সঙ্গী।

'ভেবেছিলাম স্থায়ী বেড়িবাঁধ হলে আমাদের সেই দুঃখটা ঘুচবে। কিন্তু বছর না যেতেই বেড়িবাঁধের এই হাল কেন, তার জবাব সংশ্লিষ্টরাই দিতে পারবেন। আমি কারও দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে চাই না। যেটা চাই তা হলো এটির যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে স্থায়ী একটা সমাধান।’

জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধের ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ছবি: নিউজবাংলা

স্থানীয় বাসিন্দা অ্যডভোকেট মাইনুল হোসেন সোহেল বলেন, ‘খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা ভয়াবহ। বড় জোয়ার এলেই প্লাবিত হবে গোটা ইউনিয়ন। এলাকার মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাতকানিয়া, লোহাগাড়ায় যে ভয়াবহ বন্যা ও প্রাণহানি হল সে বিষয়টা ইউনিয়নবাসীকে ভাবাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোপূর্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে লবণাক্ত পানি ঢুকে ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ ধানি জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে গেছে। উপকূলের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। দীর্ঘদিন এই বেড়িবাঁধ অরক্ষিত ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল একটি টেকসই বেড়িবাঁধ হবে। উল্লেখযোগ্য বরাদ্দও আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু যে কাজ দেখছি তাতে মনে হয় না কাঙ্ক্ষিত মান অক্ষুণ্ণ রেখে কাজ করা হয়েছে। বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। আশা করি সংশ্লিষ্ট পক্ষ এসব অভিযোগের সুরাহা করবে এবং দ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ভূমিকা রাখবে।’

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম হায়দার বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড আপদকালীন অবস্থা ঠেকাতে জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধের অবশিষ্ট অংশ ঠেকাতে কাজ করছে। সাঙ্গু নদীর মোহনায় যে চর জেগে উঠেছে তা অপসারণ করা না হলে এই বাঁধের ভাঙন রোধ করা যাবে না। যেকোনো মুহূর্তে আমরা পুরো ইউনিয়নের সবাই বিলীন হয়ে যাব।’

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘সাঙ্গু নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর ড্রেজিংয়ের ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন মন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ পরিদর্শক দল খুব তাড়াতাড়ি পরিদর্শনে আসবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। এরপর এটি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেলে বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধ করা যাবে।’

পাউবোর চট্টগ্রাম নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য জানার জন্য বেশ কয়েকবার তার মোবাইল ফোনে কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।

তবে ওই দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ সাঙ্গু নদীর মোহনায় জেগে ওঠা ওই চর। এটা ড্রেজিং করা না হলে এই ভাঙন রোধ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরাই ভাল বলতে পারবেন।’

এ বিভাগের আরো খবর