বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সোনালি আঁশের সুদিন নেই সিরাজগঞ্জে

হাটপাঙ্গাসীর পাইকারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে আমি ব্যবসা করি, কিন্তু এবারের মতো পাটের বাজার এর আগে দেখিনি। বর্তমান সময়ে পাটের যে দাম, তাতে কৃষকের কিছুই হচ্ছে না। আমরা যে কিনে নেব, আমাদের কাছ থেকেও কেনার লোক নাই।’

সোনালি আঁশ নিয়ে সোনালি স্বপ্ন থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখছেন না সিরাজগঞ্জের চাষিরা। জমিতে যতটুকু পাট উৎপাদন হয়েছে, সেটুকুর ন্যায্য দামও পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তারা।

চাষিদের ভাষ্য, উৎপাদিত পাট বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচ ওঠানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে আগামীতে আর পাট চাষ করবেন না।

এদিকে পাইকাররাও বলছেন, একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনই তারাও ব্যবসায় তেমন লাভবান হতে পারছেন না।

তাদের দাবি, সরকারিভাবে যদি আগের মতো পাট রপ্তানি করা যেত, তাহলে সবার জন্যই ভালো হতো। ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না কৃষক ও পাট ব্যবসায়ীদের।

যে চিত্র দেখা গেল হাটে

কাকডাকা ভোরেই শুরু হয় সিরাজগঞ্জের সব পাটের হাটগুলো। স্থানভেদে হাট শেষ হয় ভোর ছয়টা থেকে সকাল ৯টার মধ্যে। জেলার অন্যতম বড় পাটের হাট হাটপাঙ্গাসী ও উল্লাপাড়া।

জেলার রায়গঞ্জের হাটপাঙ্গাসীতে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকেই পাট কেনাবেচায় ব্যস্ত কৃষক ও পাইকাররা। হাটে তোষা, মেস্তা ও কেনাফসহ বিভিন্ন জাতের পাটের প্রকারভেদে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে কৃষকরা এসেছেন পাট বিক্রি করতে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পাট কিনে নিচ্ছেন পাইকাররা। পাইকাররা আবার এ পাট বিক্রি করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

কৃষক ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিকে যেমন সার, বীজ ও উৎপাদনের অন্যান্য জিনিসের দাম বেশি, তেমনই বেড়েছে শ্রমিকের মূল্যও। তাই উৎপাদন খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ। প্রতি বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন করতেই তাদের খরচ হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় পাঁচ থেকে সাত মণ পর্যন্ত পাট।

তারা জানান, এই পাট বিক্রি করতে নিয়ে আসতে আবার দিতে হয় গাড়ি ভাড়া। সব মিলিয়ে যে খরচ তাতে এই মূল্যে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। ফলে হতাশ হচ্ছেন কৃষক। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সোনালি আঁশ পাট থেকে।

একটু ধনী কৃষকেরা মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় এখন পাট বিক্রি না করলেও সাধারণ কৃষকেরা যেন বাধ্য হয়েই পাট বিক্রি করছেন কম দামে। এ ছাড়াও সঠিক সময়ে খাল-বিলে বন্যার পানি না আসায় পাট পচাতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান অনেক কৃষক। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে নষ্ট হয়েছে অনেক ফসল।

হাটপাঙ্গাসী হাটে পাট বিক্রি করতে এসে সদর উপজেলার বহুলী গ্রামের শুকুর আলী বলেন, ‘পাট বুনে তো লোকসান হয়েছে বাবা। এক বিঘায় খরচ হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পাট হয় ছয় থেকে সাত মণ। পাট বিক্রি করলাম ১৭০০ টাকা মণ ধরে। বিক্রি করে লোকসান হলো, চালানও উঠল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তেল, সার ও কীটনাশকের দাম বেশি। উৎপাদন খরচ বেশি, কিন্তু বিক্রি করে দাম পাওয়া যায় না।’

উল্লাপাড়া উপজেলার অলিপুর গ্রাম থেকে পাট বিক্রি করতে হাটে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একজন কামলার দাম ৫০০ টাকা। হাল বওয়া (চাষ) ও সার দিয়ে ম্যালা খরচ। এ ছাড়াও উৎপাদনে অনেক খরচ।

‘বারেবারে খরচ করতে হয়, তাই বোঝা যায় না। আবার পাট হাটে নিয়ে আসতেও খরচ হয়। বিঘায় পাট হয়েছে ছয় মণ। দুই হাজার টাকা মণ বিক্রি করলাম। বিক্রি করে যে টাকা পেলাম তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। এখন আবাদ (চাষাবাদ) না করলেও চলে না, তাই করি।’

শাহজাদপুর থেকে পাট বিক্রি করতে আসা আজমত আলী বলেন, ‘তিন মণ পাট এনে ১৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করলাম। একেকটা পাইট (কামলা) নিছি ৭০০ টাকা করে, তাদের আবার খাবের (খেতে) দেয়া লাগছে। পাট বেঁচে আমার ম্যালা ক্ষতি হলো।’

হাটপাঙ্গাসী হাটে পাট বিক্রি করতে আসা পাট চাষিরা।

উল্লাপাড়া হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ কুন্ডু বলেন, ‘অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ বছরে প্রতি মণ পাটের দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা কম। এখানকার বেশির ভাগ পাট খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিল ও কলকারখানায় যাচ্ছে, তবে এই পাটের তেমন কোনো চাহিদা নাই, পাটের পণ্যেরও বৈদেশিক কোনো চাহিদা নাই।

‘আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত, মাল দিয়ে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না। আবার মাল দিয়ে ঠিকমতো টাকাও পাচ্ছি না। কৃষকরাও ঠিকমতো টাকা পাচ্ছে না। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারদরে সবচেয়ে নিম্নমানের পাট ১৮০০ টাকা ও সবচেয়ে ভালো মানের পাট ২৫০০ টাকা। লোকসান কমিয়ে লাভ করার জন্য পাট বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। এতে পাটের মানও বাড়বে; বাজারে চাহিদাও বাড়বে।’

বিশ্বজিৎ কুন্ডু বলেন, ‘সরকার যদি সরকারিভাবে পাট বিদেশে রপ্তানি করতে পারে, তাহলে কৃষকও বাঁচবে, ব্যবসায়ীরাও বাঁচবে।’

জেলার সব উপজেলা থেকেই এই হাটে পাট আসে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।হাটপাঙ্গাসীর পাইকারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘৪৫ বছর ধরে আমি ব্যবসা করি, কিন্তু এবারের মতো পাটের বাজার এর আগে দেখিনি। বর্তমান সময়ে পাটের যে দাম, তাতে কৃষকের কিছুই হচ্ছে না। আমরা যে কিনে নেব, আমাদের কাছ থেকেও কেনার লোক নাই।

‘ক্রেতা না থাকার কারণে আমরা অসুবিধায় আছি। কৃষকরা বর্তমান যে দাম পাচ্ছে, তাতে তাদের লাভ তো দূরে থাক, কামলার দামই উঠবে না। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব, সরকার যেন এদিকে একটু নজর রাখে।’

উল্লাপাড়া পাটের হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান জানান, সপ্তাহে সোমবার ও শুক্রবার এই পাটের হাটটি বসে। হাটে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মণ পাট আমদানি হয়। উল্লাপাড়া ছাড়াও জেলার বেলকুচি, কামারখন্দ ও তাড়াশসহ প্রায় প্রত্যেক উপজেলা থেকেই এখানে পাট আসে। এখান থেকে সারা দেশে পাট গেলেও বেশি পাট যায় ঢাকা, খুলনা ও বগুড়াতে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জের উপপরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, সিরাজগঞ্জে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৯১০ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয়েছে ১৭ হাজার ২৯৮ হেক্টর। সিরাজগঞ্জে সাধারণত রবি-১, ৭২ ও ৯৮৯৭, জিআরও-৫২৪ জাতের পাটের আবাদ বেশি হয়। এই জাতগুলোরই তোষা পাটের আবাদ বেশি হচ্ছে ও এখন পর্যন্ত জেলায় ৯৭ শতাংশ পাট কাটা হয়েছে।

কৃষক পাটের ফলন ভালো পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর বিঘাপ্রতি গড়ে প্রায় ৮ মণ করে ফলন পাওয়া গেছে। কৃষকরা বাজারে প্রতি মণ পাটের দাম পাচ্ছেন প্রায় ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা। পাশাপাশি তারা পাটকাঠি পাচ্ছে, যা ভালো দামে বিক্রি করা যায়।

বর্তমানে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পাট পচাতে সমস্যা হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি কোথায় একেবারেই পানি না থাকে, সে ক্ষেত্রে তারা রিবন মেটিক বা রিবনারের মাধ্যমে পাটের আঁশটি ছাড়িয়ে একটা চৌবাচ্চার মাধ্যমে আঁশটিকে ভিজিয়ে রেখে পচানোর পরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাধারণত কৃষকদের আগাম জাতের পাটের চাষ করার জন্য অনুপ্রাণিত করছি। এতে তারা এরপরে আমন চাষ করতে পারবেন। এ ছাড়াও আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের চাষাবাদ সম্পর্কে সবসময়ই নানান পরামর্শ দিয়ে আসছি।’

এ বিভাগের আরো খবর