রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে আগুন। বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৩ মিনিটে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে বলতে গেলে পোড়ার আর কিছু বাকি নেই। দোকানগুলো এখন কেবলই আলু, চাল, ডাল, ফল, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের পোড়া ঢিবি।
চলতি বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি বড় বড় মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সেসব আগুনের ঘটনা পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। সবশেষ মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডে পণ্য পোড়ার পাশাপাশি পুড়েছে এখানকার ব্যবসায়ীদের স্বপ্নও। একইসঙ্গে উঠেছে কিছু প্রশ্নও।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, মার্কেটের ‘গ’ ব্লকে মুদি দোকানের অংশে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা ‘খ’ ব্লকেও ছড়িয়ে পড়ে।
আগুন নিয়ন্ত্রণ, উদ্ধার অভিযান ও সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ঘটনাস্থলে কাজ করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, আনসার, এনএসআই এবং স্কাউটের ভলান্টিয়াররা।
প্রায় ছয় ঘণ্টার আগুনে পুড়েছে স্বর্ণ, কাপড়, প্লাস্টিকের মালামাল, ক্রোকারিজ, মুদি, চাল, আলু, কসমেটিকস সামগ্রী, ফল, ব্যাগসহ হরেক পণ্যের দোকান।
কিছু কিছু দোকান থেকে খুব অল্প পরিমাণ মালামাল বের করতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য মার্কেটের বাইরের অংশের জুয়েলারির দোকানগুলোর বেশিরভাগ স্বর্ণই ব্যবসায়ীরা বের করে নিতে পেরেছিলেন।
পোড়া আলুর ঢিবি
আগুনে মূলত পুড়েছে ‘খ’ ও ‘গ’ ব্লকের দোকানগুলো। অক্ষত আছে ‘ক’ ব্লকের মাছ-মাংসের বাজার। ‘খ’ ব্লকে ছিল কসমেটিক, ব্যাগ, মুদি, বেকারি, আলু-পেঁয়াজ, ফল, সবজি ও একটি জুয়েলারি দোকান। আর ‘গ’ ব্লকে ছিল স্বর্ণ, কাপড়, ক্রোকারিজ, কসমেটিকস, ব্যাগ ও জুতার দোকান।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় মার্কেটের ‘খ’ ব্লকে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া আলুর ঢিবি। বস্তায় রাখা পুড়ে যাওয়া আলু ঢিবি বানিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকে দোকানে পুড়ে যাওয়া পেঁয়াজ থেকে ব্যবহার উপযোগীগুলো বেছে আলাদা করার চেষ্টা করছেন।
আকাশ এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী রনি হোসেন নিউজবাংলাকে বললেন, ‘রাত ২টা ৪৪ মিনিটে আমি ভ্যান থেকে মাল নামাচ্ছিলাম দোকানে। এ সময় একজন বলেন যে পার্কিং স্পেসের সামনে আগুন লেগেছে। আমি দৌড়ে যাই আগুন নেভাতে। বুঝতে পারি নাই যে আগুন এতো দ্রুত ছড়াবে। যদি আগুন নেভাতে না যেতাম, তাহলে কিছু মাল বের করতে পারতাম। প্রথমে আগুন দেখি হক বেকারিতে। সামনে দিয়ে পানি দিচ্ছিলাম। কিন্তু আগুন পেছনে দিয়ে পুরা মার্কেটে ছড়াইছে।
‘আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদ বিক্রি করতাম। আমাদের দুইটা দোকান ও একটা গোডাউন ছিল। তিন দোকানে প্রায় ১২ লাখ টাকার মাল ছিল। কিছুই বের করতে পারি নাই। সব পুড়ে গেছে। পোড়া আলু ঢিবি করে রেখেছি।’
নজরুল তরকারি ভাণ্ডারের মালিক খলিলুর রহমান বলেন, ‘আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, শুকনা মরিচ ও হলুদ বিক্রি করতাম। আমার দোকানে ৬০-৭০ হাজার টাকার মাল ছিল। কিছুই বের করতে পারি নাই। সব পুড়ে গেছে।’
শুধু আলু, পেঁয়াজ আর রসুন নয়; এই ব্লকের মুদি দোকানগুলোতে থাকা সব পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সঙ্গে চালের দোকানও পুড়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া চাল ঢিবি করে রাখা হয়েছে। অনেক ডিবি থেকেই ধোঁয়া বের হচ্ছে। কিছু রয়েছে আধপোড়া চাল। কিছু বস্তা আগুন থেকে বাঁচলেও চালগুলো পানিতে ভিজে গেছে। বস্তায় বস্তায় চালের পাশাপাশি ডালও পুড়েছে অনেক। আর মুদি দোকানে পুড়েছে প্রায় সবই।
সততা রাইসের মালিক মো. জসিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে জানতে পেরেছি। কিন্তু এসে কিছুই বের করতে পারি নাই। আমাদের দুইটা দোকান ছিল। একটা চালের দোকান, আরেকটা মুদি দোকান। সব পুড়ে গেছে।’
‘এটা ষড়যন্ত্র, আগুন লাগানো হয়েছে’
মার্কেটের ‘গ’ ব্লকে বেশিরভাগ ছিল কাপড়ের দোকান। প্রায় সব কাপড়ই পুড়ে গেছে। কিছু আছে আধ পোড়া, যা কোনোই কাজে আসবে না।
‘গ’ ব্লকের একটি কাপড়ের দোকানের মালিক সাইদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেটের উত্তর পাশেই আমার বাসা। এসে দেখি ‘খ’ ব্লকে গ্যাপ দিয়ে তিন জায়গায় আগুন। একটু পরই দেখি ‘গ’ ব্লকে আগুন চলে এসেছে। কলাপসেবল গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যায় না। দোকানে ঢুকে একটা বস্তায় কিছু মাল ঢুকাইছিলাম। পরে আমাকে টেনে বের করছে আমার কর্মচারীরা। ওই বস্তাও আর বের করতে পারি নাই।’
সাইদুল বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এটা ষড়যন্ত্র। আগুন লাগানো হয়েছে। আগুন এক জায়গায় লাগলে তা ধীরে ধীরে মার্কেটের অন্য জায়গায় ছড়াবে। অথচ গ্যাপ দিয়ে তিন জায়গায় আগুন দেখেছি আমি। আমার প্রশ্ন- তিন জায়গায় আগুন যায় কিভাবে? আগুনের সময় দারোয়ানকেও খুঁজে পাই নাই।’
তিশা জেনারেল স্টোরের কর্মচারী ইমরান বলেন, ‘মাল বের করতে পারি নাই। সব পুড়ে গেছে। রাত ৪টায় ঘটনা জানতে পারছি। এসে আর কোনো মালই বের করতে পারি নাই।’
‘পুড়েছে ১৮টি স্বর্ণের দোকান’
কৃষি মার্কেটে লাগা আগুনে ১৮টি স্বর্ণের দোকান ভস্মীভূত হয়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামনে ৯টি ও ভেতরে ৯টি দোকান ছিল।
দুবাই জুয়েলার্সের মালিক আমির হোসেন বলেন, ‘দুটি অলংকারের দোকান ছিল আমার। ভোর ৪টায় খবর পেয়ে মার্কেটে আসি। তখনও আমার দোকানে আগুন লাগেনি। মার্কেট বন্ধ থাকায় মালামাল সব সরাতে পারেনি। সামান্য কিছু আমার মতো সবাই সরিয়েছে। দুই দোকানে দুই কোটি টাকার অলংকার ছিল। মার্কেটের মোট ১৮টি স্বর্ণের দোকান ছিল। সব পুড়ে গেছে।’
সিঙ্গাপুর জুয়েলার্স আবু কাওসার বলেন, ‘দোকানে দুই কোটি টাকার কাছাকাছি মালামাল ছিল। কিছু বের করা গেছে। তবে বেশিরভাগই দোকানে ছিল। দোকানটা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।’
অগ্নিনিরাপত্তা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
কৃষি মার্কেটে অগ্নিনিরাপত্তা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম।
তাজুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফুটপাত ও সড়কে দোকান থাকা ও মানুষের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়েছে। এখানে পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। আগুন লাগা এই মার্কেটটিতে কোনো সেফটি প্ল্যান নাই। এই মার্কেটটিতে বারংবার নোটিশ দেয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে গণসংযোগ করা হয়েছে। সচেতনতার প্রোগ্রাম যেভাবে আমরা করেছি, সেভাবে তারা সাড়া দেয় নাই। এই মার্কেটটা কিছুটা বঙ্গবাজার টাইপের।
তিনি বলেন, এখানে ভেতরে অনেক সাবওয়ে ছিল। ভেতরে যতগুলো রাস্তা এবং বাইরের যে ছোট ছোট রাস্তা, পুরোটাই বিভিন্ন মালামালে দিয়ে গাদাগাদি করে রাস্তাটা বন্ধ করা ছিল এবং পুরো মার্কেট টাইট কলাপসিবল গেট দিয়ে আটকানো ছিল।
জনতার ভিড়ে আগুন নেভাতে বাধা
মার্কেটে আগুন লাগার খবর পেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় জমায় মার্কেট এলাকায়। এতে ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর কাজে ব্যাঘাত ঘটে। উৎসুক জনতাকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে।
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগুন নেভাতে বিলম্বের বড় একটি কারণ ছিল মানুষের ভিড়। এই ভিড় সামলাতে পুলিশ, বিজিবিসহ সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হয়েছে। আমাদেরও বেশি সময় লেগেছে। উৎসুক জনতার বাইরেও অনেকে আমাদেরকে আগুন নেভাতে সহযোগিতা করতে চেয়েছে। বাস্তবে তাতে আমাদের সমস্যাই বেড়েছে।’
আগুনে ২১৭ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত: ডিএনসিসি
কৃষি মার্কেটে আগুনে ২১৭টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা।
তিনি বলেন, ‘অবৈধ দোকানগুলো ছিল ফুটপাতে। আমাদের বরাদ্দ দেয়া দোকান ছিল ৩১৭টি। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক আমরা যে তথ্য পেয়েছি সে অনুযায়ী ২১৭টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ফায়ার সার্ভিসও বলেছে যে ভেতরে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। অথচ এ ব্যাপারে আমাদের সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া ছিল।’
তিনি বলেন, ‘মার্কেটের ব্যবসায়ী যারা আছেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আমরা তাদের তালিকা করছি। বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসবে। আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের পাশে আছি।’
ভাঙার সিদ্ধান্ত হওয়া মার্কেটগুলোতেই আগুন জ্বলছে: হেলাল উদ্দিন
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘গত রমজান মাসের পর রাজধানী ঢাকায় যতগুলো মার্কেটে আগুন লেগেছে, এর অধিকাংশই সিটি করপোরেশনের। এগুলো পরিকল্পিত মার্কেট না তা আমরা সবাই জানি।
‘অনেক আধুনিক মার্কেটেও অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না। সিটি করপোরেশনের যে মার্কেটগুলো ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যে মার্কেটগুলো পাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, সেই মার্কেটগুলোই আগুনে জ্বলছে। আমরা এর আগেও বঙ্গবাজার মার্কেটসহ অন্যান্য মার্কেটে আগুন দেখেছি। এবার দেখলাম কৃষি মার্কেটে।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পাকা মার্কেট চাই। তার অর্থ এই নয় যে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আমরা পাকা মার্কেট করবো। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ কারণে আমরা মনে করি ভালো তদন্ত কমিটি দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আগুন লাগলেই সিটি করপোরেশন একটা তদন্ত কমিটি করে। আর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত শেষে বলে দেয়, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। প্রত্যেক মার্কেটে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগবে, আর সেই আগুন এত ভয়াবহ হবে? আর ফায়ার সার্ভিস, যাদের আমরা এত প্রশংসা করি; কই তারা আমাদের কোনো দোকান তো বাঁচাতে পারে না?
‘বেলা ২টার সময়ও আগুন নেভেনি। আমরা চাই এটার একটা শক্ত তদন্ত চাই। আমি উত্তর সিটি করপোরেশনের সিওকে বলেছি, তদন্ত কমিটিতে যেন একজন ব্যবসায়ী রাখেন। তাহলে অন্তত আমরা জানতে পারবো কেন এই আগুন লেগেছে।’
যেহেতু সিটি করপোরেশনের মার্কেট সেহেতু অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা দায়িত্বের অবহেলা করছে কি না, এমন প্রশ্নে হেলাল বলেন, ‘অবশ্যই। যখন আগুনে আমাদের সব ধ্বংস হয়ে যায়, আমরা যখন নিঃস্ব হই তখন কথা আসে যে এখানে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এই মার্কেটের মালিক সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের যেসব মার্কেটে আগুন লেগেছে, এই দায় তো তারা এড়াতে পারে না। বেসরকারি কোথাও কিছু হলে মালিককে জেলে যেতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের তো কিছু হয় না। তাদের কোনো জবাবদিহি থাকে না।
‘আগুনের ঘটনাগুলো একই সময়ে ঘটছে এবং সব ধ্বংস হচ্ছে। সব মার্কেটের বিদ্যুতের মেইন সুইস বন্ধ করে আমরা বের হয়ে যাই। সেখানে আবার শর্টসার্কিট থেকে কীভাবে আগুন লাগে।’