মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে যোগদানের পর পাহাড় সমান সম্পদের মালিক হয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) উপসহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীম। সরকারি বিধি মোতাবেক, একজন কর্মকর্তা এক উপজেলায় তিন বছরের বেশি থাকতে পারবেনা না। তবে এ কর্মকর্তা ৯ বছর ধরে জুড়ীতে আছেন বহাল তবিয়তে।
দীর্ঘদিন এ উপজেলায় কর্মরত থাকার সুবাদে অনিয়ম-দুর্নীতির ‘উছিলায়’ বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। অনিয়ম-দুর্নীতি করে বিলাসবহুল জীবনযাপনের পাশাপাশি নিজ এলাকা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার জামুরকি ইউনিয়নের কাটরা গ্রামে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি।
সরেজমিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদতুল্য আলিশান বাড়ি। বাড়ির কারুকাজ দেখলে যে কারো নজর কাড়ে। বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ কর্মস্থলের শ্রমিক দিয়ে করিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আলিশান এ বাড়ি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যেও রয়েছে নানা গুঞ্জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, একসময় তেমন কিছু না থাকা শামীম পিডিবিতে চাকরি পাওয়ার পর যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান। গত কয়েক বছরে হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। তার সম্পত্তির উৎস নিয়ে হিসাব মেলাতে পারে এলাকাবাসী।
অনিয়মের রাজত্ব কায়েম করা শামীমের খুঁটির জোর কোথায়?- এ প্রশ্ন এখন উপজেলার সবার মুখে মুখে।
জুড়ীতে ‘পিডিবির ঘুষ, দুর্নীতি-অনিয়মের বরপুত্র’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিত লাভ করলেও তিনি সেখানে রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় একাধিক সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও পিডিবির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম চালিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সহকর্মীসহ সাধারণ গ্রাহকদের প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে চলছেন রাজার হালে। দুর্নীতির অভিযোগে একাধিকবার বদলি হলেও ‘ম্যানেজ’ করে বদলির আদেশ কয়েকবার বাতিল করেছেন এ কর্মকর্তা।
সম্প্রতি পিডিবির এ প্রকৌশলীর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তিনি সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা দিয়ে সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীম। ছবি: সংগৃহীত
সূত্র জানায়, অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে পিডিবির শামীমের মাসিক আয় অন্তত ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এ টাকা থেকে তিনি নিয়মিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতাকে প্রতিমাসে মাসোহারা দিয়ে থাকেন। মাসোহারা ও বকশিস দেয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে বা কোনো সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করলে শামীমকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগে যান মাসোহারা পাওয়া এসব নেতা। অনেকে আবার প্রকাশ্যে তার অপকর্ম আড়াল করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তার পক্ষে সাফাই গান।
সূত্র আরও জানায়, অন্য নামের মিটার সংযোগ দিয়ে পরে আবার কেটে মোটা অংকের অর্থ জরিমানার কথা বলে ঘুষ নেয়াই হলো তার মূল ব্যবসা। তবে অনেক সময় নিজ অফিসের একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের মামলার ভয় দেখিয়ে ঘুষও আদায় করে চতুর এ প্রকৌশলী।
২০১৪ সালের মে মাসে মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে যোগদান করে ৯ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীম। নানা দূর্নীতির অভিযোগে ২০২০ সালে কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি করলেও তদবির করে অদৃশ্য হাতের ইশারায় ৩ মাসের মাথায় আবারও ফিরে আসেন জুড়ীতে। জুড়ীতে যে আসলে কী মধু আছে, তা জানেন না বলে জানালেন স্থানীয়রা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন এক উপজেলায় কর্মরত থাকার সুবাদে নিজ অফিসে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নানা অজুহাতে সাধারণ গ্রাহকদের মিটার কেটে এনে মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন শামীম। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পেলে গ্রাহকদের মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে ভুরিভুরি। তার মামলার অত্যাচারে অনেকে ইএতামধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকদিন অফিসের স্টাফ আসার আগে সকালে আবার কখনও গভীর রাত অবধি অফিসে নীরবে ঘুষ বাণিজ্য করে চলেছেন শামীম। নিজ অফিস যেন তার ব্যক্তিগত ব্যবসায় পরিণত করেছেন। তার অত্যাচারে পিডিবিতে অস্থায়ী চাকুরি করা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সম্প্রতি আরও অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন অবৈধ করাতকলে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোয়ারা নিচ্ছেন উপসহকারী প্রকৌশলী শামীম। শামীমের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বারবার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। এ ছাড়া অনেক গ্রাহক বৈধ মিটার পেতে আবেদন করলেও তাদেরকে অনেক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পিডিবি অফিসে জমাকৃত পুরনো মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। পরে আবার এসব মিটার ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে মামলা দিয়ে গ্রাহকদের হয়রানি করেন তিনি।
জুড়ীতে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহের এলাকায় অসাধু বিদ্যুৎ গ্রাহকরা অটোরিকশা চার্জ করার নামে গ্যারেজ খুলে বসেছে। পাশাপাশি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে বেশ কিছু মুরগি ও গরুর খামারেও। এসব অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেয় পিডিবির এই অসাধু কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মচারী জানান, প্রকৌশলী শামীম নিজ বলয়ের কর্মচারীদের মাধ্যমে শক্তিশালী সিন্ডিকেট করে অনিয়ম-দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে অফিসে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। অফিসে কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললে ও তার কথামত না চললে তাকে বদলি, এমনকি চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন হরহামেশা। তার অত্যাচারের শিকার হয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে উপসহকারী প্রকৌশলী আনসারুল কবির শামীম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা।’
তবে সংবাদ প্রকাশ না করে প্রতিবেদককে একান্তে বসে আলাপ করার প্রস্তাব দেন তিনি।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। নিজের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করতে পিডিবির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে তিনি ধরনা দিচ্ছেন বারবার।
এ ব্যাপারে পিডিবির সিলেট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতি করে কেউ ছাড় পাবে না। প্রকৌশলী শামীমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।’