প্রথম শ্রেণির ময়মনসিংহ পৌরসভাকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে উন্নীত করা হয় সিটি করপোরেশনে। দুই দশমিক ১৫ বর্গমাইলের পৌরসভাটি সিটি করপোরেশন হওয়ার পর আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৯০ বর্গকিলোমিটারে।
ওয়ার্ড সংখ্যা ২১ থেকে বেড়ে হয় ৩৩টি। আর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট লাখে। ২৫ মাইলের রাস্তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক হাজার ১০০ কিলোমিটার। বিভাগীয় এ শহরটিতে চাকরি-ব্যবসাসহ নানা প্রয়োজনে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছেই।
পুরোনো শহরটিতে অপরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। ফলে মূল শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সড়কগুলো এক ইঞ্চিও বড় করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
নগরের খালগুলোর দুই পাশ দখল হয়ে গড়ে উঠেছে বাসা-বাড়িসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। এর ফলে বৃষ্টির পানি শহর থেকে গড়িয়ে খালে নামতে পারে না। অসচেতন বাসিন্দারা বাসা-বাড়ির বিভিন্ন ময়লা, আবর্জনা ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নির্মিত ড্রেনগুলোতে ফেলে দেয়। এতে ড্রেন দিয়ে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন এলাকায় চলছে আরসিসি ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের কাজ। নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডেই ইতোমধ্যে সড়ক যোগাযোগ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের নানা কাজ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
নগরীর কলেজ রোড, গুলকিবাড়ি রোড, বাউন্ডারি রোড, আমলাপাড়া সড়ক, বড় বাজার, ট্রাংকপট্টি, মহারাজা রোড, কালীবাড়ি কবরখানা রোড, পুরোহিতপাড়া সড়ক ও ব্রাহ্মপল্লি রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৭৪ কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণসহ ৪৭৪ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজ চলমান। এর আগে ৯২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে কঠোর পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে সিটি কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। খালের দুই পাশের বাসা-বাড়িসহ নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে দখলকারীরা অসন্তুষ্ট হলেও খুশি সচেতন বাসিন্দারা।
বৃষ্টির পানি খাল দিয়ে এখন অনায়াসেই চলে যেতে পারছে ৷ ফলে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি নিরসন হয়েছে।
ময়মনসিংহ নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসনে অবৈধ স্থাপনা ভাঙচুর। ছবি: নিউজবাংলা
ময়মনসিংহ সিটি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘মসিকের সড়ক যোগাযোগ ও ড্রেনেজ নেটওয়ার্কসহ নাগরিক সেবা উন্নতকরণ’ এ প্রকল্পে বরাদ্দের ১ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার মধ্যে ৭২৯ কোটি টাকার কাজ চলছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
বলাশপুর, আলিয়া মাদ্রাসা, মাসকান্দা, চরপাড়া, নয়াপাড়া, চামড়াগুদাম, নওমহল, আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার, সানকিপাড়া, গুলকিবাড়ি এলাকার চলমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নকাজ শেষ হলে এখানেও জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না। এ ছাড়া পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বদলে যাবে নগরীর চিরচেনা চেহারা।
ময়মনসিংহে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ক্রাশ প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। মশার লার্ভা ধ্বংসে লার্ভিসাইড ও উড়ন্ত মশা ধ্বংসে অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগ করা হচ্ছে। মসিকের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিন বাসা থেকে ময়লা না নিলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোনো বাসিন্দা যত্রতত্র ময়লা ফেললে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের আওতায় নগরীর ব্রাহ্মপল্লি এলাকায় একটি নগর মাতৃসদনসহ শম্ভুগঞ্জ, জামতলা ও খাগডহর এলাকার তিনটি পয়েন্টে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসহ প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রসূতিদের জন্য চালু করা হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। ইতোমধ্যে এসব কেন্দ্র থেকে নগরবাসী স্বাস্থ্য সেবার সুবিধা ভোগ করছেন। সামান্য ফিতে মা ও শিশুরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন।
স্থানীয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ের যানজট নিরসন এবং শম্ভুগঞ্জ সেতুর ওপর যান চলাচলের চাপ কমাতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি হারবারের আদলে ময়মনসিংহে দৃষ্টিনন্দন স্টিল আর্চ ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত দেশের প্রথম স্টিল আর্চ ব্রিজের মাঝখানে থাকবে না কোনো পিলার। নদের দুই পাশে থাকবে দুটি পিলার। দুটি পিলারের ওপর বসবে ১৮০ মিটারের একমাত্র স্প্যানটি। এ জন্য এ ব্রিজটি হবে দেশের প্রথম দর্শনীয় মডেল ব্রিজ।
এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ নামে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। প্রকল্পে চীনের এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ঋণ হিসেবে দেবে ১ হাজার ৯৩০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
৩২০ মিটার ধনুক আকৃতির এ স্টিল আর্চ ব্রিজ সুপার স্ট্রাকচার নির্মাণে ব্যয় হবে ৪০৭ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। চার লেনের সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। এ ছাড়া এ প্রকল্পের অধীনে একটি টোল প্লাজা, একটি ৫৫১ মিটার দৈর্ঘ্যের ওভারপাস সড়ক, ২৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি রেলওয়ে ওভারপাস ও সেতুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হবে।
সেতু এবং সংযোগ সড়কটি হবে চার লেনের। সেতু নির্মাণের প্রাথমিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৩ হাজার ২০০ যানবাহন চলাচল করবে।
জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নগরীর প্রায় প্রত্যেকটি সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। রাতের ঝলমলে আলোতে নগরবাসী রাতের বেলাতেও এখন নিশ্চিন্তে চলাচল করছেন, তবে নগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট ও জলাবদ্ধতা।
‘পানি নিষ্কাশনে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরীর উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়েছেন। বরাদ্দের এ টাকার যথাযথ ব্যবহার ও টেকসই সুফল আমরা দেখতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্টিল আর্চওয়ে সেতুটির সুফল পেতে সবাই অপেক্ষায় রয়েছি। আশা করছি, প্রকল্পের যথাযথ নিয়ম মেনে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে।’
ময়মনসিংহে দৃষ্টিনন্দন স্টিল আর্চ ব্রিজ নির্মাণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
মসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘ভোগান্তিবিহীন ও সুন্দর নগরী গড়তে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসন করতে খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং খাল সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে নয়াপাড়া খালপাড়, গণশার মোড়ের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ অনেক স্থানে অবৈধভাবে নির্মাণ করা বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত ৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানে ইতোমধ্যে প্রায় ৬ কিলোমিটার খালের দখল উচ্ছেদ ও সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খানকার পুল, আকুয়া খালপাড়া, মাসকান্দা গণশার মোড়, নয়াপাড়া খাল পাড় এসব এলাকার খালগুলোর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ২৫ থেকে ৪০ ফুট প্রশস্ত করা হয়েছে। এতে খালের পানি প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আকুয়া কবরস্থান সংলগ্ন খাল, বাড়েরা খাল, মাসকান্দা খালের উজান ও ভাটির অংশ এবং মিতা ক্লিনিকের পার্শ্ববর্তী এলাকার খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
‘গণশার মোড় থেকে চরপাড়া পর্যন্ত, বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে নওমহল হয়ে আকুয়া পর্যন্ত এবং গোয়াইকান্দী খালের দখল উচ্ছেদ এবং সংস্কার করা হবে। খালগুলোর দখল উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগ ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী খায়রুল বাশার মুহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্টিল আর্চ সেতু নির্মাণের সময়কাল ধরা হয়েছে চার বছর। আগামী মাসের মধ্যেই নির্মাণকাজ শুরু হবে। সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে ময়মনসিংহের সঙ্গে শেরপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম ছাড়াও জেলার সাতটি উপজেলার যোগাযোগে সুবিধা বাড়বে এবং রাজধানীর সঙ্গে নাকুগাঁও এবং হালুয়াঘাট স্থলবন্দরের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।’
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ি করার আগে ড্রেনের জন্য জায়গা ছাড়তে হবে। অনেকে পাইলিংয়ের মাটি সরাসরি ড্রেনে ফেলে ড্রেনকে অকার্যকর করে দেয়।
‘অনেকে আবার ময়লা আবর্জনা, বোতল, বস্তাসহ কঠিন আবর্জনা ড্রেনে ফেলে দেয়। এ অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। না হলে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীর উন্নয়ন করাই প্রধান লক্ষ্য। সে জন্য উন্নয়নের নানা কর্মযজ্ঞ চলমান রয়েছে। ভোগান্তিবিহীন ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে নগরবাসীকেও সহযোগিতা করতে হবে।’