নামের মিলই কাল হলো চট্রগ্রামের যুবক দেলোয়ারের জন্য। নিজে কোনো অপরাধ না করেও শুধুমাত্র নামের মিল থাকার কারণে গ্রেপ্তার হতে হয় তাকে; করছেন হাজতবাসও।
মঙ্গলবার এরকমই ঘটেছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে।
গ্রেপ্তারের সময় ভুক্তভোগী যুবক বারবার নিজের পরিচয়পত্র দেখানোর চেষ্টা করলেও তা দেখতে রাজি হয়নি ভুজপুর থানা পুলিশ। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর সুযোগ না দিয়ে ‘সময় নেই’ জানিয়ে দ্রুত ভুক্তভোগীকে নিয়ে পুলিশ থানায় চলে যায় বলে অভিযোগ স্বজনদের।
এমনকি গ্রেপ্তারের পর স্বজনরা ভুক্তভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্রসহ থানায় গিয়ে ৬ ঘণ্টা ধরে পুলিশকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। থানার ওসির কাছে গিয়েও হয়নি সমাধান।
সে সময় নির্দোষ হলে স্বজনদের আদালত থেকে ভুক্তভোগীকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয় পুলিশ।
২৭ বছর বয়সী দেলোয়ার ভুজপুর থানার দাঁতমারা ইউনিয়নের মুহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবার নাম বাচ্চু মিয়া ও মায়ের নাম আয়েশা খাতুন।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের ২১১/২১ নং মামলার আসামি আনুমানিক ৫০ বছরেরও বেশি বয়সী দেলোয়ারের বাড়ি পাশ্ববর্তী গ্রামপাড়া এলাকায়। তাদের দুজনের বাবা-মায়ের নামেও মিল নেই।
সূত্র জানায়, আসল আসামি দেলোয়ার ব্র্যাক ব্যাংকের হালিশহর শাখা থেকে তার বড় ছেলে শহিদুল ইসলামের নেয়া ৬ লাখ টাকা ঋণের জামিনদার। ৬ বছর আগে শহিদুলের মৃত্যু হওয়ায় সেই ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব পড়ে বাবা দেলোয়ারের ওপর। নির্দিষ্ট সময়ে ওই ঋণ পরিশোধ না করায় তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে ঋণ খেলাপি মামলা করে ব্যাংক।
সম্প্রতি ওই মামলায় দেলোয়ারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। সেই পরোয়ানায় থাকা মূল আসামি দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার না করে মুহাম্মদপুর এলাকার ২৭ বছরের যুবক দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আটক যুবকের ভাই গিয়াস উদ্দিন বলেন, ’১০ থেকে ১২ দিন আগে ভুজপুর থানার দাঁতমারা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে একবার নিয়ে গিয়েছিল আমার ভাইকে। পরে আমি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে পুলিশকে দেখালে তারা এক ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মঙ্গলবার রাত তিনটার দিকে এসে আবার তাকে নিয়ে যায় ভুজপুর থানার এসআই খাইরুল। এসময় আমার ভাই জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর জন্য সময় চাইলে সময় নেই বলে তাকে দ্রুত থানায় নিয়ে যায়।’
অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পরদিন সকাল সাতটায় আটক দেলোয়ারের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে থানায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখান। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা থানার ওসির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।’
কিন্তু ভুজপুর থানার ওসি হেলাল উদ্দিন ফারুকীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এর কোনো সমাধান পাননি তিনি। ওইদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত থানায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করলেও তার কথা আমলে নেয়নি পুলিশ। এসময় পুলিশ জানায়, আটক ব্যক্তি নির্দোষ হলে আদালত থেকে তাকে ছেড়ে দিবে।
আটক যুবকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমরান নাঈম বলেন, ‘কোনো আসামি গ্রেপ্তারের সময় তার নাম পরিচয় নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা যাচাই করে নিতে হয়। কিন্তু পুলিশ তা না করেই নিরপরাধ দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠিয়েছে।’
এ বিষয়ে মূল আসামি দেলোয়ার ও মূল ঋণ গ্রহীতা শহিদুলের পারিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে পলাতক দেলোয়ার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে শহিদুলের স্ত্রী রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী চট্টগ্রাম শহরের সবুজবাগ এলাকায় ব্যবসা করতেন। ২০১৭ সালের ১৯ মে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তিনি এখানে কয়েকটি ব্যংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সেসব ঋণের মধ্যে আড়াই লাখ টাকার মত জামিনদার আমার বাবা। এখন তিনি রিকশা চালিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করছেন। তবে আমার স্বামী কখনো শহরের কোনো ব্যংক থেকে ঋণ নিয়েছে কিনা তা আমি জানি না। গ্রামের ঋণের বিষয়ে এলাকার সবাই জানে।’
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি আমি মাত্রই অবগত হয়েছি। আমি জানতাম না; জেনে আপনাকে জানাব।’
এর কিছুক্ষণ পর ফোন করে তিনি বলেন, ‘ওসি যখন এটা বুঝতে পারছে যে সঠিক লোককে ধরা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে আবার কোর্টে ফোন করে ওসি তাকে রিলিজ দেয়ার জন্য বলেছে। আটক দেলোয়ার এখন বাইরে।’
তবে এর তিন মিনিট পর ভুক্তভোগীর ভাই গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই এখনও কারাগারে। তবে নামের ভুলে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি আদালতের নজরে এনেছেন আইনজীবী। তাই আদালত তাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। আজ বিকেল ৫টা পেরিয়ে যাওয়ায় তার মুক্তি হয়নি। আগামীকাল তাকে মুক্তি দেয়ার কথা রয়েছে।’
তার নিরপরাধ ভাইকে গ্রেপ্তার করে কারাবাস ও পরিবারকে হয়রানির বিচার ও ক্ষতিপূরণ চান গিয়াস উদ্দিন।
যথাযথভাবে নাম-ঠিকানা যাচাই না করে অপরাধীর পরিবর্তে নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘বারবার নামের ভুলে নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তারের পরও দোষীদের বিচার না হওয়ায় এ ঘটনা বারবার ঘটছে। ভুজপুর থানায় এরকম একটি ঘটনা ঘটার পর তো থানার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে ক্লোজ করা উচিত। তাদের তো চাকরির অধিকার নেই! পুলিশ জনগণের বন্ধু, তারা কেন নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করবে? পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য হলেও তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’