জামালপুরের বকশীগঞ্জে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ড ঘিরে উঠে আসছে একের পর এক প্রশ্ন। ঘুরপাক খাচ্ছে নানা রহস্য।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) মাহমুদুল আলম বাবু ইতোমধ্যে ধরা পড়েছেন। তাকে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। তবে এই ঘটনার নেপথ্যে অন্য কোনো শক্তি বা ব্যক্তির ইন্ধন রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে নানা মহল থেকে।
অভিযোগ উঠেছে, নাদিম হত্যার নেপথ্যে বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ শাহীনা বেগমের হাত রয়েছে। এলাকায় একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে ‘বিন্দু মাসি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই নারী নেত্রীর বিষয়টি তদন্তে গুরুত্ব পেলে বেরিয়ে আসতে পারে ‘থলের বেড়াল’।
নিহত সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বলেন, ‘আমি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার স্বামী সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করতেন। রাজাকার পরিবার ও অপকর্মের হোতা প্রভাবশালী কিছু লোকের বিরুদ্ধে বেশকিছু সংবাদ করার কারণে স্থানীয়ভাবে তিনি রাজনৈতিক হয়রানির মধ্যে থাকতেন।’
জানা গেছে, গোলাম রাব্বানী নাদিম বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ শাহীনা বেগমকে নিয়ে একাত্তর টিভিতে সংবাদ পরিবেশন করেন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর প্রচারিত ওই সংবাদে শাহীনা বেগম রাজাকারের সন্তান হয়েও আওয়ামী লীগে পদ-পদবি লাভের তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংবাদটি প্রচারের পর শাহীনার লোকজন সাংবাদিক নাদিমের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ফেসবুকে নানা আপত্তিকর মন্তব্য এবং তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১ এপ্রিল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন নাদিম। তাতে নয়াপাড়া গ্রামের খায়রুল হাসান মিলন মিয়াকে একমাত্র আসামি করা হয়, যিনি শাহীনা বেগমের আস্থাভাজন লোক হিসেবে পরিচিত। মিলন মিয়া নাদিম হত্যা মামলারও ১০ নম্বর আসামি।
তবে বকশীগঞ্জ থানার পুলিশ নাদিমের ওই অভিযোগ আমলে নেয়নি। পাল্টা ওই ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বকশীগঞ্জ মধ্যবাজার এলাকায় সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলা চালায় শাহীনা বেগমের লোকজন।
পরদিন ১২ এপ্রিল নাদিম আরেকটি লিখিত অভিযোগ দেন থানায়। এতে শাহীনা বেগমকে হামলার হুকুমদাতা উল্লেখ করে ১ নম্বর আসামি করা হয়।
ওই অভিযোগপত্রে নাম উল্লেখ করা পাঁচ আসামির মধ্যে তিনজনই নাতিম হত্যা মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি। তাদের মধ্যে ১২ এপ্রিলের লিখিত অভিযোগের ৩ নম্বর আসামি ইসমাইল হোসেন স্বপন মণ্ডল হত্যা মামলায় ৮ নম্বর আসামি। এছাড়া অভিযোগের ৪ নম্বর আসামি খন্দকার শামীম হত্যা মামলায় ৯ নম্বর আসামি এবং অভিযোগের ৫ নম্বর আসামি শেখ ফরিদ হত্যা মামলায় ১৩ নম্বর আসামি।
অর্থাৎ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ২২ আসামির মধ্যে চারজনই নাদিমের দাখিল করা দুটি লিখিত অভিযোগের আসামি ছিলেন। আর এই চারজন সরাসরি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহীনা বেগমের হয়ে এলাকায় কাজ করেন।
ওদিকে পর পর দুটি অভিযোগ দায়েরের পরও থানার ওসি তা আমলে না নেয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন নাদিম। এক ভিডিওবার্তায় তিনি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশেরেঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি কামনা করেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি এই সাংবাদিক।
ইতোমধ্যে উপজেলার সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (সদ্য বহিষ্কৃত) মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। নির্ভীক সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম জীবনের নিরাপত্তাহীনতা উপেক্ষা করে কলম ধরেন ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দেন বাবু।
১৪ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওই মামলা খারিজ হয়ে গেলে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বাবু চেয়ারম্যান। মামলা খারিজের চার ঘণ্টার মধ্যে হামলা করা হয় সাংবাদিক নাদিমের ওপর। পরদিন ১৫ জুন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
‘বিন্দু মাসি’ নামে পরিচিত বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহীনা বেগমের সঙ্গে নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবু চেয়ারম্যান। ছবি: সংগৃহীত
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বকশীগঞ্জ আওয়ামী লীগে একাধিক গ্রুপ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নাদিমের হত্যাকারীরা বাবু চেয়ারম্যানের হয়ে কিলিং মিশনে অংশ নিলেও তারা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহীনা বেগমের গ্রুপেও সক্রিয়। তার ইন্ধনেই আসামিরা এলাকায় পরস্পর রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকতেন।
অপরদিকে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্নার চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে তার প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিক আয় এবং প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ করতেন বাবু চেয়ারম্যান।
এদিকে ২০ জুন সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবু চেয়ারম্যানের একটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে। ২৬ সেকেন্ডের ওই রেকর্ডে মাহমুদুল আলম বাবুকে বলতে শোনা যায়, ‘নাদিম সাংবাদিককে... আমি মনে করবো এর জন্য দায়-দায়িত্ব উপজেলা আওয়ামী লীগের। নাদিম সাংবাদিককে ঠিক করতে ১ মিনিটের বিষয়। আমি যামু ওরে শাসন করতে। আবার যদি উপজেলা আওয়ামী লীগ হা হা করে হাসে যে বাবু বিপদে পড়ছে, পড়ুক!’
নাদিমের সহকর্মী সাংবাদিক ইমদাদুল হক লালন বলেন, ‘ভাইরাল হওয়া অডিওটির কণ্ঠ মাহমুদুল হক বাবুর। নাদিমের ওপর হামলা হওয়ার আগে তিনি আওয়ামী লীগের কোনো একটি দলীয় বৈঠকে বসে এ বক্তব্য দেন।’
বাবু চেয়ারম্যান সাংবাদিক নাদিমকে ‘শায়েস্তা’ করার এ বক্তব্য উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহীনা বেগমের সামনেই দিয়েছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়।
অপরদিকে প্রথমবার নাদিমের ওপর হামলার ঘটনায় শাহীনা বেগমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং ফের বাবু চেয়ারম্যানের হামলা- উভয় ঘটনায়ই ওসির ভূমিকা একইরকম এবং রহস্যজনক। ১৪ জুন নাদিম আহত হওয়ার পর ওসি সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নাদিমের তেমন কিছু হয়নি, চোখে সামান্য আঘাত পেয়েছেন।’
অপরদিকে নাদিমের মৃত্যুর পর ওসি মন্তব্য করেন, ‘বাবু চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংবাদিকরা লিখলেও সবাই একসময় থেমে যায়। কিন্তু নাদিম না থেমে ধারাবাহিক নিউজ করছিল এবং ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছিল। তাই বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। সুতরাং সাংবাদিকতার জন্য এই হত্যা হয়নি।’
নাদিম হত্যার নেপথ্যে পরস্পর পৃথক ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা কিনা তা নিয়ে সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ওসির ভূমিকা রহস্যজনক হওয়ায় তাকেও মামলায় সম্পৃক্ত করার দাবি উঠেছে।
সোমবার (১৯ জুন) দুপুরে সাংবাদিক নাদিম স্মরণে শোকসভা ও দোয়া মাহফিলে জামালপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান অভিযোগ করেন, বকশীগঞ্জ থানার ওসি সোহেল রানার ভূমিকা রহস্যজনক। তাকে প্রত্যাহারসহ হত্যা মামলায় তাকেও আসামি করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
জামালপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘সাংবাদিক নাদিমের হত্যাকারী বাবু চেয়ারম্যানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও চাচাতো ভাই সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্না এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহীনা বেগমের ইন্ধন থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে শাহীনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ সঠিক নয়, মিথ্যা ও বানোয়াট। একটি পক্ষ রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অভিযোগ আনছে। আমি ঘটনার দিন ঢাকায় ছিলাম।’
এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, ‘নাদিম হত্যা মামলাটি এখন ডিবি তদন্ত করছে। গ্রেপ্তার হওয়া ১৩ আসামি বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশের রিমান্ডে আছে। ৬ জনকে ৪ দিনের রিমান্ড শেষে আজ (বৃহস্পতিবার) আদালতে তোলা হয়েছিল। তাদের মধ্যে আসামি রেজাউল করিম ও মনিরুজ্জামান সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার কথাই বলেছে। তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাবে না।’
মামলার তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে কারও সম্পৃক্ততা প্রমাণ হলে সে যত বড় শক্তিধরই হোক ছাড় দেয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেন ওসি।
জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার বিকেলে তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে আবারও যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।