দেশের ৭ জেলায় বজ্রপাতে শিশু ও নারীসহ মোট ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের মধ্যে নরসিংদীতে পৃথক বজ্রপাতের ঘটনায় ৪ জন প্রাণ হারান। এছাড়া কুমিল্লা, পাবনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ জন করে এবং কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নওগাঁয় মারা যান একজন করে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ওই ১৩ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারান। এ সময় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন।
সুনামগঞ্জে স্কুলছাত্র নিহত
নদীপথে ট্রলারে করে ধান পরিবহনের সময় বজ্রপাতে সুনামগঞ্জে ওমর মিয়া নামে এক স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে ধর্মপাশা উপজেলার ৪ নম্বর জয়শ্রী ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের সীমের খাল (বরাইয়া) নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
১৬ বছরের ওমর মিয়া উপজেলার বাদে হরিপুর গ্রামের মৃত আলিম উদ্দিনের ছেলে। ধর্মপাশার জয়শ্রী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল সে।
এ সময় তার সঙ্গে থাকা একই গ্রামের শাহীন, কালাচান ও আবুল কাশেম আহত হয়েছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার সকালে ধর্মপাশা থানার সীমের খাল (বরাইয়া) নদীতে ট্রলারে করে মধ্যনগর ধান নিয়ে যাওয়ার সময় বজ্রপাতের আঘাতে ওমর মিয়া নৌকা থেকে নদীর পানিতে পড়ে যায়। প্রায় ২ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর মাছ ধরার জাল দিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘সকালে ধান নিয়ে মধ্যনগর যাবার পথে ট্রলারে বজ্রপাত হয়। এ ঘটনায় ১ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়েছেন। আহতরা স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৃথক ঘটনায় নিহত ২
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় বজ্রপাতে মোজাম্মেল হক নামে ৩২ বছর বয়সী এক ইটভাটা শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কাইয়ুম মিয়া নামের ৩০ বছর বয়সী আরেক শ্রমিক আহত হন।
মোজাম্মেল উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ওই গ্রামের মতি মিয়ার ছেলে।
নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফখরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ইউএনও ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সোনাতলা গ্রামের হাওর এলাকার এক ইটভাটায় কাজ করছিলেন মোজাম্মেল ও কাইয়ুম। সকাল ১১টার ঝড় ও বজ্রপাত শুরু হলে বজ্রাঘাতে মেজাম্মেল নিহত হন। এসময় কাইয়ুম আহত হন।
নিহত মোজাম্মেলের পরিবারকে সরকারি খাত থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও। আহত কাইয়ুমকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অপরদিকে একই সময়ে বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে অলি মিয়া নামের এক কৃষক নিহত হন।
তিনি বুড়িশ্বর ইউনিয়নের আশুরাইল গ্রামের নমিজ উদ্দিনের ছেলে।
বুড়িশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘বজ্রপাতে আতঙ্কিত হয়ে এক শ্রমিক মারা গেছে বলে আমি শুনেছি। তবে তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।’
নরসিংদীতে নারীসহ নিহত ৪
নরসিংদী জেলার পৃথক ৪ স্থানে বজ্রপাতে এক নারীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রায়পুরা, মনোহরদী ও পলাশ উপজেলায় দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
নিহতরা হলেন- মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের পাতরদিয়া গ্রামের মৃত বাদল মিয়ার ৩০ বছরের ছেলে রায়হান মিয়া, রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের ফকিরের চর গ্রামের মোমরাজ মিয়ার স্ত্রী ৪৫ বছর বয়সী শামসুন্নাহার, নিলক্ষা ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের ইসমাইল মিয়ার ১২ বছরের ছেলে জাবেদ মিয়া ও পলাশ উপজেলার একজন।
রায়হানের স্বজনরা বলেন, ‘দুপুরে বাড়ি থেকে একটু দূরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন প্রবাস ফেরত রায়হান মিয়া। হঠাৎ বজ্রসহ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে রায়হান বাড়ি ফেরার পথে বাড়ির কাছে পৌঁছামাত্র বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরে স্বজন ও স্থানীয়রা তার লাশ উদ্ধার করে।’
কাতার প্রবাসী রায়হান মিয়া দুই মাস আগে ছুটিতে দেশে আসেন বলে জানান স্বজনরা।
বেলা ১১টার দিকে বজ্রপাতে নিহত হন গৃহবধূ শামসুন্নাহার। তিনি রায়পুরার শ্রীনগর ইউনিয়নের ফকিরের চর গ্রামের বাসিন্দা।
শ্রীনগর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য জালাল উদ্দিন বলেন, ‘খড়ের গাদা তৈরির জন্য বাড়ির পাশের একটি জমি থেকে খড় আনতে গিয়েছিলেন গৃহবধূ শামসুন্নাহার। তখন বৃষ্টির সাথে ব্যাপক বজ্রপাত হয়। এ সময় বজ্রাঘাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।’
খবর পেয়ে স্বজনরা গিয়ে শামসুন্নাহারের লাশ উদ্ধার করেন বলে জানান তিনি।
দুপুর ২টার দিকে একই উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়নের গোপীনাথপুরে বাড়ির সামনে ফুটবল খেলার সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় জাবেদ মিয়া নামে এক কিশোর।
এছাড়া উপজেলায় সকালে কৃষিজমিতে কাজ করার সময় দক্ষিণ সাধারচরে বজ্রপাতে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
নিহত ৩০ বছর বয়সী খোকন মিয়া দক্ষিণ সাদারচর গ্রামের খোরশেদ মিয়ার ছেলে।
নিহতের স্বজনরা জানান, মঙ্গলবার সকালে জমিতে কৃষিকাজ করতে যান খোকন মিয়া। এ সময় বজ্রপাতে তিনি আহত হন। স্থানীয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নওগাঁয় প্রাণ গেল যুবকের
নওগাঁর রানীনগরে বজ্রপাতে জামিল প্রামানিক নামে ২০ বছর বয়সী এক যুবক নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত জামিল উপজেলার গোনা ইউনিয়নের ভবানীপুর এলাকার মৃত আজাদ প্রামানিকের ছেলে।
স্থানীয়দের বরাতে পুলিশ জানায়, বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ করলে জামিলসহ কয়েকজন একটি ভুট্টাক্ষেত থেকে ভুট্টা তুলছিলেন। এ সময় বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জামিলকে মৃত ঘোষণা করে।
রানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভুট্টাক্ষেতে কাজ করার সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই মারা যান জামিল। এ বিষয়ে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ নেই।’
কিশোরগঞ্জে নিহত ১
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বজ্রপাতে কাজী জিল্লুর রহমান নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের লুন্দিয়া খলাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জিল্লুর রহমান ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর কাজীবাড়ির মৃত কাজী গোলাপ মিয়ার ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, জিল্লুর রহমান মাক্কু মোল্লা নামের একটি ফুড কারখানায় কাজ করতেন। কারখানার কাজে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি ওই এলাকায় যান। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে তিনি পায়ে হেঁটে ফেরার সময় বজ্রপাতের শিকার হন। ঘটনার পর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সোহরাব হোসাইন। ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পাবনায় বজ্রপাতে ২ ধানকাটা শ্রমিক নিহত
পাবনার ভাঙ্গুড়ায় মাঠে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে ২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও ১১ জন।
মঙ্গলবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় ভাঙ্গুড়া উপজেলার বেতুয়ান, ছোট বিষাকোল ও পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার আল্লাহবাদ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শ্রমিকরা জেলার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা গ্রামের বাসিন্দা ১৯ বছরের শাকিল হোসেন ও ৩০ বছর বয়সী রমিজ উদ্দিন।
বজ্রপাতে আহতদের ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকরা জানান, দিলপাশার ইউনিয়নের বেতুয়ান গ্রামের বাওনজান এলাকায় বোরো ধান কাটছিলেন ১৫ জন শ্রমিক। মঙ্গলবার বিকেলে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। এতে শ্রমিকরা পাশের খোলা জায়গার একটি ঘরে আশ্রয় নেন।
কিছুক্ষণ পরে বজ্রপাত হলে ওই ঘরে আশ্রয় নেয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৫ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ২ জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
এছাড়া মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উপজেলার ছোট বিষাকোল ও পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার আল্লাহবাদ গ্রামের আরো ৮ জনকে ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বেতুয়ান গ্রামের ইউপি সদস্য আরজু খান মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বিকেল থেকেই বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত শুরু হয়। এতে দুই শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহতদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’
ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’
কুমিল্লায় বজ্রপাতে কৃষক ও ছাত্রের মৃত্যু
বজ্রপাতে কুমিল্লার দুই জায়গায় দুজন নিহত হয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে একজন দেবিদ্বার উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের ইদন মিয়ার ছেলে ৩০ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম। অপরজন চান্দিনা উপজেলার বুড়িমারা গ্রামের মাস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে রিফাত হোসাইন।
সাইফুল ইসলামের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন দেবিদ্বার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার।
তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলে বাড়ির অদূরে সাইফুল তার জমিতে কাজ করছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। পরে পরিবারের লোকজন তার মরদেহ বাড়ি নিয়ে যায়।’
অপরদিকে একই দিন দুপুর আড়াইটায় কুমিল্লা চান্দিনা উপজেলার বুড়িমারা গ্রামে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হয় হিফজ পড়ুয়া রিফাত হোসাইন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চান্দিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবউদ্দিন খান।
চান্দিনা থানার ইউএনও তাপস শীল বলেন, ‘রিফাত বাড়ির পাশে ঘুড়ি ওড়াতে যায়। বৃষ্টি শুরু হলে এক পর্যায়ে বজ্রপাতে নিহত হয় সে।’
সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নওগাঁ, কিশোরগঞ্জ, পাবনা ও কুমিল্লা জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে প্রদিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।