বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান (বাইগাম)-এর সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের একাধিক নারী কর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও এখন একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন নির্যাতিতরা। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগও দেয়া হয়েছে।
যৌন হয়রানির শিকার একাধিক নারী নিউজবাংলার কাছে অভিযোগ করে বলেন, সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের নানাভাবে যৌন হয়রানি করে থাকেন। নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তিনি টার্গেট করা নারী কর্মীদের চাকরিগত নানা সমস্যা তৈরি করে রাখেন। আর সেসব সমস্যা নিয়ে নারী কর্মীদের তার কাছে ধরনা দিতে বাধ্য করেন।
একাধিক নারী কর্মীর অভিযোগ, সহকারী পরিচালকের সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধানে তার কাছে গেলে তিনি নানা অনৈতিক প্রস্তাব দেন। তাতে রাজি না হলে সুযোগ বুঝে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আটকে দেন।
বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় সব নারী কর্মীকে এভাবে বিপাকে ফেলে আশরাফুল আলম মাসুম নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেন। এমনকি নারী কর্মীদের অনেকটা বিপাকে ফেলে বা জবরদস্তি যৌন হররানি করেন।
বেশ কয়েকজন নারী কর্মী এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মাসুমের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ দিলেও বরাবরই বাইগামের আগের কর্তৃপক্ষ অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। উপরন্তু অভিযোগ দেয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নারী কর্মীরা ১০-১২ বছর চাকরি করেও ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতিসহ সব ধরনের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।
মৌখিকভাবে অভিযোগ করে কোনো কাজ না হওয়ায় ১২ এপ্রিল বাইগামের বর্তমান প্রশাসকের কাছে সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটিতে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত এক নারী কর্মী।
লিখিত অভিযোগকারী ওই নারী কর্মীর সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তার পুরো বক্তব্যই সংরক্ষিত আছে আমাদের কাছে। তবে সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে তার নাম প্রকাশ করা হলো না। ওই অফিসের আরও একাধিক নারী কর্মী সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। তবে লোকলজ্জার ভয়ে তারা নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
ভুক্তভোগীদের একজন মরিয়ম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহায়ক পদে (এমএলএসএস) ১২ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে আসছি। আমি কাজে যোগদানের শুরু থেকেই প্রশাসন বিভাগের আশরাফুল আলম মাসুম স্যার আমাকে উত্ত্যক্ত করা শুরু করেন। সে সময় আমি এ বিষয়ে তৎকালীন মহাসচিবকে মৌখিকভাবে জানালে তিনি আমাকে প্রশাসন বিভাগ থেকে সরিয়ে হাসপাতাল বিভাগে ডিউটি দেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা থেকে রেহাই মেলেনি।
‘মাসুম স্যার নানাভাবে প্রলোভন দিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। বিষয়টি আমি আমাদের তৎকালীন অনেক ইসি সদস্যকে জানাই। তারা সে সময় মাসুম স্যারকে মৌখিকভাবে সাবধান করে দেন। এরপর কিছু দিনের জন্য চুপ থাকলেও তিনি আবার আমাকে হয়রানি করতে শুরু করেন।’
মরিয়ম বলেন, অফিসে লিফটের ভেতর কয়েকবার একা পেয়ে মাসুম স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এমনকি বিভিন্ন ছুতোয় অফিসে লোকজন কম থাকলে বিভিন্ন জায়গায় আমার কাছে গিয়ে আমার শরীর স্পর্শ করেন। সেসব ঘটনায় আমি চিৎকার করে কোনোরকম বেঁচে যাই।’
তিনি বলেন, মাসুম স্যার যে আমাকে মাঝেমধ্যেই যৌন হয়রানি করেন সেটা আমাদের অফিসের সবাই জানে। আর স্যারের কথায় আমি সায় দেইনি বলে এই অফিসে ১২ বছর চাকরি করেও আমি কোনো প্রমোশন বা ইনক্রিমেন্ট পাইনি। অফিসে আমি প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকি- কখন স্যার আমাকে জাপটে ধরেন সেই ভয়ে।
ভুক্তভোগী এই নারী বলেন, ‘এখন আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তাই আমি আর মৌখিক অভিযোগ না করে এবার সরাসরি প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। আমি জানি এবার মাসুম স্যারের বিচার না হলে আমার আর এখানে চাকরি করা হবে না। আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। এখন দেখি বর্তমান স্যারেরা কী বিচার করেন।
‘আমি এখন আর ভয় পাই না। আপনারা পত্রিকায় আমার নামসহ বক্তব্য ভিডিও আকারে প্রকাশ করে দিন। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমার এই কথার কারণে যদি আমার অফিসে আরও অনেক মেয়ের জীবন এই মাসুম স্যারের থাবা থেকে বেঁচে যায় সেটাকেই বড় পাওনা মনে করব।
‘মাসুম স্যারের যৌন হয়রানির শিকার শুধু আমি একা নই। এই প্রতিষ্ঠানে আমার মতো আরও ১০ থেকে ১২ জন নারী কর্মী তার যৌন হয়রানির শিকার। অফিসের সবাই তা জানে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে নির্যাতিতরা কেউ মুখ খোলেন না। তাই আমি এবার প্রকাশ্যে এসে স্যারের এসব অপকর্মের বিচার চাইছি।’
মরিয়মই ছাড়াও বাইগামে কর্মরত আরও দুই নারী কর্মী নিউজবাংলার কাছে সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘আমরা সব সময় মাসুম স্যারের ভয়ে থাকি। চেষ্টা করি একা না থেকে ২-৩ জন এক সঙ্গে থাকতে। কারণ আমাদের একা দেখলেই মাসুম স্যার যে কোনো ছুতোয় কাছে এসে আমাদের শরীরে হাত দেন। এমনকি কোনো অফিস ফাইল স্যারের কাছে নিয়ে গেলেও ২-৩ জন একসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করি।
‘তারপরও মাসুম স্যার বিভিন্ন ছুতোয় আমাদের আলাদা আলাদা করে অফিসের বিভিন্ন জায়গায় ডেকে নিয়ে যান। সে সময় স্যার আমাদের নানাভাবে হয়রানি করেন, যেসব মুখে বলা সম্ভব নয়। আমাদের পরিবার আছে। তাই চুপ করে সব সয়ে যাই। মরিয়ম লিখিত অভিযোগ দিয়ে আমাদের মনের কথা বলেছে। আমরা ওর সঙ্গে আছি।’
এ বিষয়ে প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুস খান বলেন, ‘মাসুমের বিরুদ্ধে এই যৌন হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়। অনেক আগেই আমাদের কাছে এমন অভিযোগ এসেছিল। তখন শুনেছিলাম আমাদের প্রতিষ্ঠানের ছাদে দারোয়ানদের একটা রুম ছিলো। মাসুম ওই রুমে মেয়েদের ডেকে নিয়ে হয়রানি করতো।
‘সে সময় মাসুমকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। তবে ওই একবার নয়, আরও কয়েকবারই তাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তো আর ওইরকম ক্ষমতা নেই যে ব্যবস্থা নেবো। যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারাই তো চুপ থাকে। আর তাদের সঙ্গেই মাসুম চলাফেরা করে।’
এদিকে অধস্তন নারী সহকর্মীদের যৌন হয়রানির এসব অভিযোগকে অপপ্রচার বলে উল্লেখ করেন বাইগামের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম মাসুম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ দিয়েছেন কিনা সেটা আমার জানা নেই। এমনও হতে পারে- কেউ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটা মিথ্যা অভিযোগ।’
তবে বাইগামের বর্তমান প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. মো. মোকতার হোসেন জানান, মাসুমের বিরুদ্ধে তারই প্রতিষ্ঠানের এক নারীর যৌন হয়রানির একটি লিখিত অভিযোগ তিনি পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আশরাফুল আলম মাসুমের বিরুদ্ধে আগেও এরকম অভিযোগ শুনেছিলাম। কোনো লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তবে কিছুদিন আগে বাইগামেরই এক নারী কর্মী এই মাসুমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এখন বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে মাসুমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ড. মোকতার হোসেন জানান, ইতোমধ্যে সহকারী পরিচালক মাসুমকে তার পদ থেকে সরিয়ে প্রবীণ হাসপাতালের ফার্মেসির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।